Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

ভূমিহীন লোকমান ‘চরাঞ্চলে জ্বালিয়েছেন আলোর বাতিঘর’







কেউ বলে দাদু, কেউ বলে চাচা আবার কেউ বলে ভাই। ডাক নাম ভিন্ন হলেও তিনি চরাঞ্চলের শিশুদের কাছে লোকমান গুরু মশাই। এই লোকমান হোসেন দীর্ঘ একদশক ধরে নিজ ঘরে পাঠশালা খুলে চরাঞ্চলের সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের বিনা পারিশ্রমিকে শিক্ষাদান করে আসছেন। তিনি ব্ল্যাকবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেন ঘরের দরজা। শুধু পড়াচ্ছেন না। গরিব ছেলে-মেয়েদের খাতা, কলম, শিশুদের মুখরোচক খাবার ও কখনো পোশাকও কিনে দিচ্ছেন নিজের টাকায়। স্বল্প শিক্ষিত লোকমান আলীর এমন শিক্ষানুরাগী আচরণে মুগ্ধ ও অভিভূত চরাঞ্চলের মানুষ। সর্বজন শ্রদ্ধেয় লোকমান আলী এখন গ্রামটির ‘সাদা মনের মানুষ আর আলোর বাতিঘর’।



একবার দুইবার নয়, তিস্তার গ্রাসে পাঁচবার বসতভিটা হারিয়েছেন লোকমান আলী। এরপরও মনোবল হারাননি তিনি। মাদুর বিছিয়ে চার ছেলে-মেয়েকে আলোকিত মানুষ গড়ার পাশাপাশি চরাঞ্চলের ছেলে-মেয়েদের বিনামূল্যে কোচিংয়ে পড়িয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন।

লোকমান আলী লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের তিস্তা নদীর তীর বারঘড়িয়া আদর্শপাড়া গ্রামের আবদার আলীর একমাত্র ছেলে। প্রাচুর্যের মাঝে বড় হওয়া লোকমান আলীকে যৌবন বয়স পর্যন্ত অভাব নামক দানবটি ছুঁতে পারেনি। কিন্তু ১৯৯২ সালে তিস্তার হিংস্র থাবায় বিলিন হয় লোকমানদের সব সম্পত্তিসহ বসতভিটা। আশ্রয় নেন অন্যের জমিতে। কয়েক বছরের মধ্যে টানা পাঁচবার ভিটেবাড়ি সড়াতে হয় তাদের। অবশেষে বারঘড়িয়া আদর্শপাড়ায় মামার দেয়া মাত্র চার শতাংশ জমিতে বসবাস শুরু করেন তারা। সম্পদহানীর দুঃচিন্তায় হঠাৎ তার বাবার মৃত্যু হয়। পুরো সংসারের দায়িত্ব পড়ে লোকমান আলীর কাঁধে।



১৯৯৬ সালে অভাবের তাড়নায় স্ত্রী নুরনাহার ১৪ দিনের এক ছেলেসহ চার সন্তানকে ফেলে অন্যের ঘরে পাড়ি জমান। সেই থেকে চার সন্তান ও মা নবিয়ন নেছাকে নিয়ে লোকমান আলীর নতুন জীবন সংগ্রাম শুরু হয়। এক বেলা চা ও এক বেলা ডাল-ভাত খেয়ে অভাবের সঙ্গে লড়াই করে চার সন্তানকে লেখাপড়া শিখিয়ে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। নিজে না খেয়ে থাকলেও প্রতিবেশীদের মুখে খাবার পৌঁছে দিয়েছেন তিনি।



দীর্ঘ সংগ্রামের এ জীবনে এখন তার একমাত্র মেয়ে প্রভাষক, বড় ছেলে সদ্য বিসিএস স্বাস্থ্যে উত্তীর্ণ হয়ে যোগদানের অপেক্ষায় এবং মেঝ ছেলে রাজশাহী বিশ্বাবিদ্যালয় থেকে সদস্য স্নাতকোত্তর সমাপ্ত করে বিসিএসের প্রস্তুতিতে ও ছোট ছেলে স্নাতক শাখায় অধ্যায়ন করছেন।

কষ্টেভরা জীবনে নিজের সন্তানদের প্রতিষ্ঠিত করেই খান্ত হননি লোকমান আলী। বরং চরাঞ্চলের শিশুদের বিনামূল্যে সকাল বিকেল পড়াচ্ছেন তিনি। এজন্য বাড়ির একটি ঘরকে পাঠশালা বানিয়ে মাদুর বা চাটাই বিছিয়ে পরম যত্নে পড়াচ্ছেন তিনি।



এবিষয়ে কথা হলে লোকমান আলী প্রতিবেদককে বলেন, জীবনে শেষ বলে কিছু নেই। শেষ থেকেই শুরু করতে হয়। কষ্ট জীবনের একটা অংশ মাত্র। কষ্ট না করলে জীবন রঙ্গিন হয় না। শত কষ্টের মাঝেও অর্থাভাবে নিজের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া বন্ধ হতে দেইনি। তাই চরাঞ্চলের শিশুরা যেন অর্থের অভাবে ঝরে না পড়ে। তাই ১০ বছর ধরে এ প্রচেষ্টা তার। যাতে চরাঞ্চলের ছিন্নমূল পরিবারের শিশুরা সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।

লোকমান আলী আরো বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয়ের ক্লাসের ফাঁকে সকাল ও বিকেলে দুই শিফটে প্রায় ৭০জন শিক্ষার্থী তার অবৈতনিক কোচিংয়ে লেখাপড়া করছে। আগে মাদুর বিক্রির টাকায় এখন সন্তানের আয়ের অংশ দিয়ে সাধ্যমতো সাহায্যের চেষ্টা করি।



গরিব শিক্ষার্থীদের খাতা কলমের পাশাপাশি পোশাকও দিয়ে থাকেন সাধ্যমত। মূলত সুবিধাবঞ্চিত ছিন্নমূল পরিবারের শিশুদের সুন্দর শৈশব ও কৈশোর গড়ে তুলতে এমন উদ্যোগ তার। নিজের সন্তানের মতই পুরো গ্রামের শিশুদের আলোকিত করতে চান লোকমান আলী। এ জন্য মৃত্যুর আগ পর্যন্ত অবৈতনিক এ বিদ্যালয়টি চালিয়ে যেতে চান তিনি।

লোকমান আলীর শিক্ষার্থী নাদিয়া সুলতানা নিপু, জান্নাতি ও সুমাইয়া জানায়, কোন টাকা ছাড়াই পড়ার সুযোগ পেয়ে সময়মত সমবেত হয় তারা। খাতা কলম বা পোশাকই নয়, ক্ষিদে লাগার কথা শুনলেই ঘরে যা থাকে খাইতে দেন লোকমান দাদু।

লোকমান আলীর বৃদ্ধ মা নবিয়ন নেছা বলেন, অনেক দিন নিজের খাবার অন্যকে দিয়ে পানি খেয়ে রাত কাটিয়েছে লোকমান। অভাবের তাড়নায় যে ঘর ছেড়ে আমার ছেলের বউ পালিয়েছে, সেই ঘর আজ গ্রামের শিশুদের কোলাহলে মুখরিত। পুরো গ্রাম জুড়ে সন্তানের প্রশংসা শুনে মা হিসেবে নিজেকে খুব গৌরবন্বিত মনে করেন নবিয়ন নেছা।





ওই গ্রামের কলেজ শিক্ষক রবিউল আলম বলেন, লোকমান আলীর মত সাদা মনের মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। তবুও চার সন্তানকে আলোকিত মানুষ করার পাশাপাশি গ্রামের শিশুদের শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করে গ্রামজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবানরা যা করতে পারেননি, অর্ধশিক্ষিত ও ভূমিহীন এ লোকমান আলী তা সম্ভব করে উচ্চ শিক্ষিতদের অবাক করে দিয়েছেন।

দক্ষিণ বালাপাড়া কামিল মাদরাসার অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আব্দুল বাতেন ফারুক বলেন, না খেয়ে থাকলেও লোকমান আলী কারো সাহায্য গ্রহণ করেন না। পুরস্কার স্বরূপ তার মেধাবী চার সন্তানকে ফরম পূরণসহ সব বিষয়ে ছাড় দেয়া হত। অন্যের জমিতে আশ্রিত থেকে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে অন্যের সন্তানকে বিনা বেতনে পাঠদান করিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছেন লোকমান আলী।

মহিষখোচা ইউপি চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন চৌধুরী বলেন, মাঝে মধ্যে না খেয়ে থাকত লোকমান আলী। সাহায্যের জন্য সরকারি সহায়তা পাঠালে তিনি গ্রহণ না করে পাশের দুস্থ প্রতিবেশীকে দিতে বলেছেন। এমন স্বার্থহীন ও সাদা মনের মানুষ এ এলাকায় বিরল।

কোন দাতা সংস্থা বা সরকারের আর্থিক সহযোগিতা পেলে চরাঞ্চলের এই সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য লোকমান হোসেন আরও অনেক কিছুই করতে পারতেন বলে সুধীজনের মতামত।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.