Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

প্রবাস থেকে শূন্য হাতে দেশে ফেরার যন্ত্রণা


প্রবাস জীবন মানে হলো দুঃস্বপ্ন। আমার এক রুমমেট প্রায়ই বলে দুঃস্বপ্ন তো ক্ষণিকের জন্য, ঘুম থেকে জেগে উঠলেই সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কিন্তু প্রবাস জীবন হলো এক ধরনের ভয়ঙ্কর বাস্তবতা। এ হলো আমাদের অভিশপ্ত জীবন। দেশে অর্থকষ্টে থাকলেও আপনজনদের সান্নিধ্য পেতাম। এখন উপলব্ধি করছি জীবনে টাকার অভাবের কষ্টের চেয়েও আরও ভয়াবহ কষ্ট আছে আর তা হলো আপনজনকে ছেড়ে একাকী দূরে থাকা।

প্রবাসের এই কষ্ট জানার পরও অনেকেই বিদেশে যাবার জন্য উঠেপড়ে লাগে। অনেকে মনে করে প্রবাস মানেই জীবনের একটা গতি হওয়া। বেকার থাকার যন্ত্রণার চেয়ে প্রবাসে দিন মজুরির কাজ করাও স্বস্তি। আর প্রবাসের যাওয়ার এই আগ্রহের কারণ, বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ। এখানে বেশীরভাগ লোক দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করে।

আমাদের অনেকগুলো সমস্যার মধ্যে জনসংখ্যা সমস্যা একটি। জনসংখ্যার আধিক্যতার কারণে প্রতি বছর হাজার হাজার লোক বেকার হচ্ছে। আর শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাও দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে।

তাই কর্মক্ষম বেকার ও শিক্ষিত বেকারের একটা বড় অংশ হতাশ হয়ে অর্থ উপার্জনের জন্য প্রবাসে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। প্রবাসে এসে অনেকেই সফল হয়। পরিবারকে আর্থিক নিরাপত্তা দিতে সক্ষম হয়। আবারও অনেকেই যে স্বপ্ন নিয়ে প্রবাসে আসে তা পূরণে ব্যর্থ হয়ে শূন্য হাতে দেশে ফিরে যায়।

নিম্ন আয়ের মানুষগুলো যারা ঘর-বাড়ি বিক্রি কিংবা বেসরকারি সংস্থা থেকে কড়া সুদে অর্থ নিয়ে প্রবাসে এসে অনেক সময় সুবিধা পায় না। তাই তারা ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে এক বুক কষ্ট ও হতাশা নিয়েই শূন্য হাতে দেশে ফেরে। আমার ছোট ভাই প্রবাসের ব্যর্থতা নিয়ে বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি মেনে নিয়ে কিছুদিন আগে দেশে ফিরেছে।

ছোট ভাইকে বিনা অপরাধে ১৫ দিন কারাবন্দি থাকতে হয়েছে। যেদিন দেশে ফেরে সেদিন তাকে বিমানবন্দরে রিসিভ করতে যাই। তার বেশভূষা দেখে প্রথমে বুঝতে কষ্ট হলো এই আমার ছোট ভাই। তার পরনে জেলখানা থেকে দেওয়া একটি টি-শার্ট ও টাউজার পায়ে প্লাস্টিকের স্যান্ডেল। মুখভর্তি দাড়ি।এই কয়দিন জেলে বন্দি থেকে তার চেহারা সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো গুরুতর অপরাধে শাস্তি পেয়ে এসেছে। তার অবস্থা দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারলাম না। কান্নায় বুক ফেটে যাচ্ছে।

গাড়িতে বসে তার কাছে ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাইলাম। সে বলতে আরম্ভ করল তার বন্দি জীবনের কথা। আর আমি খুব মনোযোগী হয়ে তার সব কথা শুনছি। কষ্টে আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছিল।

সেদিন আমরা চারজন কাজ শেষ করে সাইটে বসে ছিলাম। কথা ছিল আমাদের লরি এসে অন্য সাইটে নিয়ে যাবে। চারজন গল্প করার সময় চারপাশে নজর রাখতে খেয়াল ছিল না। ঠিক তখনই পুলিশ এসে হাজির সেখানে। আমাদের আকামা দেখে বলল তোমরা হাউস ড্রাইভার তোমরা এখানে কি কাজ কর? আমি মিথ্যে কথা বললাম তবুও কাজ হলো না। আমাদের চারজনকে হাতকড়া পরিয়ে পুলিশের গাড়িতে উঠানো হলো।

আমাদের যে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয় সে গাড়িতে সর্বোচ্চ ত্রিশজন লোক বসতে পারবে কিন্তু ওই গাড়িতেই আমাদের ৫০ জনকে তুলে বসানো হয়। একজন আরেকজনের গায়ের উপর বসে বহু কষ্টে গন্তব্যে এসে পৌঁছলাম।

সেখানেও আরেক বিড়ম্বনা। গিয়ে দেখি লম্বা লাইন তার মানে আমাদের মতো আরও অনেককেই সেদিন গ্রেফতার করেছিল। লাইনে চার ঘণ্টা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। একটানা চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা কত যে কষ্টের তা বোঝাতে পারব না। চার ঘণ্টা পর আমাদের জানানো হলো, আমাদের অন্য থানায় নিয়ে যাবে।

এবারও একজনের উপর আরেকজনকে বসিয়ে পুলিশের গাড়ি অন্য থানায় নিয়ে গেল। সেখানেও লম্বা লাইনে দাঁড়ালাম। সারাদিন কিছু খাইনি। ক্ষুধার জ্বালায় টিকতে পারছিলাম না। পানির পিপাসায় প্রাণ যায় যায় অবস্থা। ওরা কতটা নিষ্ঠুর ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখছে। বসার সুযোগ নেই, খাবার নেই, পানি নেই। ভয়াবহ কষ্ট চরমে ছিল। আর পুলিশ আমাদের সাথে এত খারাপ ব্যবহার করছে তাতে মনে হয়েছিল আমি পৃথিবীর জঘন্যতম অপরাধী। আমাকে তারা ফাঁসিতে ঝুঁলাবে।

তখন পরিস্থিতি দেখে ইচ্ছে হচ্ছিল নিজেকে নিজে শেষ করে দেই। এত টাকা খরচ করে এখানে এসেছি এই পুরস্কার পাবার জন্য। সেদিন রাত দুইটার সময় আমাদের জেলখানায় নিয়ে যায়। রাতে সামান্য একটি রুটি ও জুস দেওয়া হয়। যা খেয়ে ক্ষুধা আরও বেড়ে যায়। আমি সেদিন হাউমাউ করে কেঁদেছিলাম। আর নিজেকে নিজে গালি দিয়েছিলাম, কেন এলাম এই প্রবাসে!

জেলখানায় যারা সিনিয়র ছিল তাদের ব্যবহার ও ছিল জঘন্য। মনে হয়েছিল তারা জেলখানার রাজা আর আমরা প্রজা। সারারাত ঘুম নেই। মাথার উপর হাজার ভোল্টের বাল্ব জ্বললে কি করে ঘুম হবে! আর চোখ দুটি বন্ধ করতে গেলেই সিনিয়ররা চেঁচিয়ে বিরক্ত করে।

দুইদিন অর্ধাহারে থাকার পর একজনের মাধ্যমে জানতে পারি এখানে টাকা দিলে বাহিরে থেকে খাবার কিনে দেওয়ার লোক আছে। ভাগ্য ভালো আমার সাথের একজনের সঙ্গে কিছু টাকা ছিল সেই টাকা দিয়েই চারজন বাহিরে থেকে খাবার কিনে এনে খেতাম।

জেলখানায় বসে নিজেকে খুব অসহায় ও তুচ্ছ মনে হয়েছিল। একাকী কান্না ছাড়া কিছুই করার ছিল না। কত স্বপ্ন ছিল অথচ আজ শূন্য হাতে দেশে ফিরতে হলো। শূন্য হাতে এভাবে দেশে ফিরে নিজেকে অসহায় লাগছে। আমি ছোট ভাইয়ের কথা শুনে আর কিছু বলতে পারিনি। তাকে শান্ত্বনা দেবার মতো ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

তাকে নিষেধ করা হয়েছিল বিদেশ যেতে। এমনকি তাকে বলেছিলাম, প্রবাস জীবন সুখকর নয়। কিন্তু সে আমাদের যুক্তি মানতে নারাজ ছিল। কেউ যদি একবার প্রবাসে যাবার নাম মুখে আনে প্রবাসে না যাওয়া পর্যন্ত সে কোনো কাজে তার মন বসাতে পারে না। সারাক্ষণ তার মন পড়ে থাকে প্রবাসে। আমার ছোট ভাইয়েরও একই অবস্থা হয়েছিল।

আমরা তো জানি প্রবাসে কতটা কষ্ট, কতটা ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। তাই আমরা চাইতাম সে দেশেই কিছু করুক। কিন্তু সে নাছোড়বান্দা, বিদেশ যাবেই।

তার সাথে পেরে না উঠে আমাদের এক আত্মীয়ের মাধ্যমে তাকে সৌদি আরব পাঠানোর বন্দোবস্ত করা হয়। সে আত্মীয় সৌদিতে নেওয়ার আগে বলেছিল, ফ্রি ভিসায় নিয়ে যাবে। সে যে কোনো কাজ করতে পারবে। তবে ড্রাইভিং ভিসায় গেলে ভালো করতে পারবে। সেই কথামতো তাকে ড্রাইভিং শেখানো হয়। বেতনের কথা জিজ্ঞেস করলে বলা হয় তার বেতন হবে ৫০ হাজার টাকা। আমরাও সে কথামতো তার কাছে টাকাও জমা দেই।

এক বছর পরও যখন ছোট ভাইকে সৌদিতে নিতে পারছিল না। তখন আমরা আমাদের টাকা ফেরত চাইলাম। তখন সে বলেছিল, এখন সৌদির অবস্থা ভালো না। তাকে এখন আনলে ত্রিশ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে। আস্তে আস্তে বেতন বাড়ানো হবে। আমরা অন্য কোনো উপায় না পেয়ে রাজি হয়ে গেলাম।

সৌদিতে যাবার পর শুনলাম তাকে নেওয়া হয়েছে হাউস ড্রাইভিং ভিসায়। অথচ কথা ছিল ফ্রি ভিসায় নেওয়া হবে। সেখানে তাকে দেওয়া হলো ইলেকট্রনিক কাজ। কয়েকমাস কাজ করার পর সৌদি পুলিশের হাতে সে গ্রেফতার হয়। যারা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে লোকদের প্রবাসে নিয়ে ভোগান্তিতে ফেলে সরে যায় তারা মানুষ নামের জানোয়ার।

শুধু আমার ছোট ভাই না, তার মতো এমন হাজারো প্রবাসী সৌদি আরবের জেলে বন্দি জীবনযাপন করে শূন্য হাতে প্রতিদিন দেশে ফিরছে। এমনকি এখনো প্রতিদিন অনেকে গ্রেফতার হচ্ছে। আর প্রবাসীদের এই ভোগান্তির কারণ দালালদের মিথ্যা প্রতিশ্রুতি। দালালরা সাধারণ মানুষদের প্রবাসে নেয়ার আগে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে যা প্রবাসে গেলে তাদের কথার সাথে কাজের মিল পাওয়া যায় না। প্রবাসে যাওয়ার পর প্রবাসীরা সব টের পেলেও জায়গা-জমি বিক্রি ও ঋণের বোঝার কারণে দেশে ফিরে যেতে পারে না।

যেহেতু আমাদের দেশের লোকদের প্রবাসে যাওয়া ছাড়া গতি নেই সেহেতু সরকারের উচিত এই ব্যাপারে সঠিক দিক-নির্দেশনা দেওয়া। যারা দালালি করে মানুষকে ঠকায় তাদের বিরুদ্ধে কঠিন আইন করা উচিত। তাহলে নিরীহ অসহায় মানুষগুলো প্রবাসে গিয়ে হয়রানির শিকার হবে না।

তারাও দেশের অর্থনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে। আর যারা প্রবাসে যাবে তাদেরও এ ব্যাপারে সতর্ক থাকাটা জরুরি। কারো মিষ্টি কথায় প্রবাসে গিয়ে কষ্ট করার চেয়ে দেখেশুনে ভালো কোম্পানিতে যাওয়াই শ্রেয়।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.