Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

আইন এবং ইসলামে নিষিদ্ধ হলেও বাংলাদেশে কেন টিকে আছে যৌতুক প্রথা?







দেশের আইনে যৌতুক প্রথা নিষিদ্ধ। সেইসঙ্গে ইসলামে যৌতুক নিষিদ্ধ হলেও ৯০ শতাংশ মুসলিমের দেশ বাংলাদেশে টিকে গেছে এই জঘন্য প্রথা। ২০ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ঢাকার কড়াইল বস্তিতে এসেছেন শিল্পী আক্তার। তিনি বলেছেন, মেয়ের বিয়ের সময় যৌতুক ছাড়া বিয়ে হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতিতে তাকে রীতিমতো টাকার পরিমাণ নিয়ে ছেলে পক্ষের সাথে দরকষাকষি করতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত যৌতুক দিয়েই মেয়ের বিয়ে দেন তিনি। কিন্তু এতে কি আদৌ সুখী হয়েছে মেয়ে?



বাস্তব অভিজ্ঞতা
শিল্পী আক্তারের ভাষায়, ‘দুই পক্ষের সাথে দেখা সাক্ষাত হলো। তারপর কথাবার্তা ঠিক হলো। কিন্তু যৌতুকের বিষয়ে দেখা গেলো যে বলল আমাকে এক লাখ টাকা দিতে হবে। আমি বললাম এক লাখ টাকা দেয়ার মতো আমার সামর্থ্য নেই। তখন ছেলে পক্ষ এক লাখের যায়গায় আশি হাজার টাকা চাইলো। আমারতো ওই আশি হাজার গুছিয়ে দিতে হলো।’

তিনি বলেছেন মেয়ের সুখের জন্য তাকে এটি করতে হয়েছে। কিন্তু প্রায়শই সুখের বদলে অনেক মেয়ের কপালে বরং নির্যাতন জোটে। ঢাকার বনানীতে গৃহকর্মীর কাজ করেন নরসিংদীর শিরিন আক্তার। বছর দুয়েক আগে মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। সেখানে একটি ছেলেও হয়েছে। বিয়ের সময় কিছু স্বর্ণের গয়না দেয়ার কথা ছিল। পুরোটা দিতে পারেননি, তাই মেয়ের উপরে নানা সময়ে নির্যাতন চলে বলে জানালেন তিনি।



সেই বর্ণনা দিয়ে শিরিন আক্তার বলেন, ‘আমি দিতে পারব বলে স্বীকার করেছিলাম। কিন্তু দিতে পারিনি। মেয়েকে মারে। বলে তাকে ভাত দেবে না। মেয়ে কান্নাকাটি করে। পরে গিয়ে নিয়ে আসতে হয়। যৌতুক দিতে পারলে ভালো আর না দিতে পারলেই কষ্ট।’

বাংলাদেশে যৌতুকে কারণে নির্যাতন ও মামলা
বিভিন্ন সংবাদপত্রের খবরের সূত্র থেকে নেয়া বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে ২০১৮ সালে ১০২ জন নারীকে যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এই তথ্যকে একটি আংশিক চিত্র বলে মনে করা হয় কারণ অনেক তথ্যই খবরের কাগজে প্রকাশ পায় না।বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী গত দুই বছরে ৬৭২৮ টি যৌতুকের মামলা হয়েছে। বাংলাদেশে আইনত যৌতুক দেয়া ও নেয়া নিষিদ্ধ।

কিন্তু তবুও বাংলাদেশের সমাজে যৌতুক খুবই স্বীকৃত একটি বিষয়। মেয়ের কোন শারীরিক সমস্যা থাকলে, গায়ের রং চাপা হলো অথবা পাত্র বড় চাকুরে হলো তার পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। ইদানীং হয়ত সেটি নেয়ার ধরন বদলেছে। শহুরে শিক্ষিত পরিবারে মেয়ের বিয়ের সময় সরাসরি অর্থের বদলে গয়না, ঘরের আসবাবপত্র, গৃহস্থালিতে ব্যবহারের নানা সামগ্রী উপহার হিসেবে দেয়া হয়।



এমনকি জামাতাকে ফ্ল্যাট বা গাড়ি উপহার দেয়ার প্রচলনও রয়েছে। গ্রামীণ পরিবারে গয়না, টাকা, মোটরসাইকেল দেয়ার চল রয়েছে। তবে টাকার দাবিটাই বেশি। কড়াইল বস্তির শিল্পী আক্তার বলেছেন, তাদের মতো গরীবদের জন্য এটি অনেক বড় চাপ। তিনি বলেছেন, ‘চাপ বলতে কী, অতিরিক্ত চাপ। গরীব হয়ে জন্ম নেয়াটাই আমাদের ভুল।’

ইসলাম ধর্মে যৌতুক নেয়া নিষিদ্ধ
যৌতুকের দাবি মেটাতে গিয়ে অনেক সময় ধারদেনা হয়ে যায়। জমি বিক্রি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ একটি মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ। ঢাকায় কমলাপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের খতিব খাজা মোহাম্মদ আরিফ রহমান তাহেরি ব্যাখ্যা করছিলেন কী কারণে ইসলাম ধর্ম যৌতুক নিষিদ্ধ করেছে।



তিনি বলেছেন, ‘ইসলাম ধর্মে যৌতুক নিষিদ্ধ হওয়ার মুল কারণ হলো এটাকে আপনি যদি উপঢৌকন হিসেবে নেন তাহলো হলো এক বিষয়। আর এটাকে নির্দিষ্ট করে যদি নেয়া হয় যে স্ত্রীর বাড়ি থেকে নির্দিষ্ট জিনিস দিতে হবে, সেটি মেয়ের পরিবারের উপর জুলুম করা হবে। সেই জুলুমটাকে ইসলাম ধর্মে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করেছে।’

যৌতুক প্রথার ইতিহাস

বাংলাদেশে হিন্দু-মুসলিম সকল ধরনের পরিবারে যৌতুকের প্রচলন রয়েছে। এই সমাজে যৌতুকের এতটা বিস্তার কোথা থেকে হলো? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক সামিনা লুৎফা বলেছেন বাংলাদেশের সমাজে যৌতুক প্রথার অনেক পুরনো ইতিহাস রয়েছে।

তিনি বলেন, ‘যখন একটা বড় শক্তিশালী গোষ্ঠী দাড়িয়ে যায় তখন তাদের সংস্কৃতিটাই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে ডমিন্যান্ট হয়ে ওঠে। সেই ক্ষেত্রে আপনি বলতে পারেন হিন্দুদের মধ্যে এটা ছিল বলে ইতিহাসে জানতে পারি। শত শত বছর ধরে তারা যে সব সাংস্কৃতিক এলেমেন্ট যুক্ত করেছেন সেগুলোতো সহজেই চলে যায় না।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আর এখানে কৃষি ভিত্তিক সমাজে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আমরা কদিন আগেও পুরোটা কৃষিভিত্তিক ছিলাম। কৃষিভিত্তিক সমাজে নারী হচ্ছে অধস্তন ও অন্যের উপর নির্ভরশীল। এখানে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে পুরুষ। নারী প্রোডাক্টকে চাইলেই বদলে আরেকটা নিয়ে নেয়া যায়। যেহেতু একটা নির্ভরশীল জিনিসকে এক সংসার থেকে অন্য আর একটা সংসারে পাস করা হচ্ছে সেজন্য সমাজ তার দাম দিচ্ছে।’

সামাজিক নিরাপত্তার অভাব এর একটি বড় কারণ

যদিও বহুদিন যাবত যৌতুক প্রথা উচ্ছেদে অনেক ধরনের কাজ বাংলাদেশে হচ্ছে। তারপরও এত ধরনের শিক্ষা, এনজিওদের প্রচার-প্রচারণা, আইন ও শাস্তি সত্ত্বেও বাংলাদেশের সমাজে যৌতুক শক্তভাবে টিকে গেছে। সামিনা লুৎফা বলেছেন, সামাজিক নিরাপত্তা বোধের অভাব এর একটি বড় কারণ।

তিনি বলেন, ‘কোনো নারীকে যদি দুষিত করতে পারেন মানে রেপ করতে পারেন বা শারীরিক সম্পর্ক করতে পারেন তাহলো শুধু নারী নয় পুরো কমিউনিটির ইজ্জত চলে যায় বলে মনে করা হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বোধের অভাবে যৌতুক দিয়ে হোক, বুড়ো লোকের সাথে হোক, যত রকম ভাবেই হোক না কেন নারীকে পার করা হয়।’

যৌতুকের ব্যাপারে পুরুষদের ভাবনা

ফরিদপুর থেকে ঢাকায় আসা খুচরো ব্যবসায়ী আবুল বাশার ব্যাপারী নিজে দুই মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন মেয়েদের ভরন পোষণ যেহেতু স্বামীকে দিতে হয়, তাই হয়ত ছেলেরা একবারে কিছু অর্থ নিয়ে নেয়।

সামিনা লুৎফা বলেছেন, কৃষি ভিত্তিক সমাজে যৌতুক খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তার ভাষায়, ‘যৌতুক দেয়া মেয়ে পুরোপুরি বিরাট দায়িত্ব। তার মান ইজ্জত, খাওয়া দাওয়া, তার ভরণ পোষণ, কাপড়চোপড় ছেলেকেই দিতে হয়। গরীব ছেলে হয়ত বিয়ে করে কিছু টাকা নেয় ওই বৌ নিয়ে একটা কাজ করে সংসার চালানোর জন্য।’

যৌতুক বাংলাদেশে আইনেও নিষিদ্ধ

বাংলাদেশে ১৯৮০ সাল থেকে আইন দিয়ে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এরপর দুই দফায় সংশোধন করে গত বছর তা হালনাগাদ করে যৌতুক নিরোধ আইন, ২০১৮ নামে নতুন আইন পাশ করা হয়। যেখানে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর পর্যন্ত শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। তবে এর সাথে নির্যাতন জড়িত থাকলে তখনই শুধুমাত্র এই মামলা গুরুত্ব পায় এবং তা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন দিয়ে বিচার করা হয়।

আইন অমান্য করে হলেও কেন যৌতুকের দিকে এত আগ্রহ?

এই প্রশ্নের জবাবে মানবাধিকার কর্মী, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নীনা গোস্বামী বলেছেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতি যৌতুক প্রথা টিকে থাকার অন্যতম কারণ। তার ভাষায়, ‘চোখের সামনে কেউ শাস্তি প্রদান দেখে না। বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে বড়বড় হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা বিচারের আওতায় আসছে না। রায় পাওয়া যাচ্ছে না। সেই যায়গায় যৌতুকের একটা মামলা করে এক দুই বছরের শাস্তি হয়। তাও অনেক সময় শাস্তি হয়না। যদিও না কোন সময় শাস্তি হয়, তার বিরুদ্ধে আপিল করে সেই মামলা আবার পরে থাকে।’

তিনি আরও বলেছেন, ‘আর এগুলো শশুর বাড়িতে হয় বলে নারীরা তা প্রমাণ করতে পারে না। কারণ সাক্ষী সব শশুর বাড়ির। এই যায়গাগুলোর কারণে নারীরা মামলা প্রমাণ করতে পারছে না। নারীরা প্রমাণ করতে পারছে না বলে মামলাগুলোতে শাস্তি হয় না।’

যৌতুকের কারণে প্রায়শই ভয়াবহ শারীরিক মানসিক নির্যাতনের পরেও বেশিরভাগ সময় স্বামীর বাড়িতেই মেয়েকে ঠেলে দেয় পরিবার। যেমনটা করেছেন শিরিন আক্তার। আর শিল্পী আকতারকে এখনো মাঝে মাঝেই জামাতাকে টাকা দিতে হয়। কিন্তু এত কিছুর পরেও যৌতুকলোভী জামাতার কারণে মেয়ের কপালে সুখ নেই বলে আক্ষেপ করেন তিনি।
– বিবিসি

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.