Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

মরুর বুকে শত প্রবাসীর স্বপ্নভঙ্গ


চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার বলীরহাটের আবদুল মোনাফের ছেলে আবু তালেব। করতেন বালুর ব্যবসা। ভাগ্যের পরিবর্তনের আশায় তিনি মরুভূমির দেশ সৌদি আরবে পাড়ি জমান ২০১৭ সালের শেষের দিকে। কিন্তু ঘাটে ঘাটে প্রতারণার শিকার হয়ে নিঃস্ব হয়ে ফিরেছেন গতকাল সকালে।
বাড়ি ফিরে স্ত্রী ও কন্যাকে জড়িয়ে তার কান্না কাঁদিয়েছে সবাইকে। তাদের সঙ্গে কেঁদেছেন আত্মীয়স্বজন ও পাড়া প্রতিবেশীও। শেষে প্রাণে বেঁচে ফেরার স্বাত্বনা। স্ত্রী হাজেরা খাতুন চোখের জল মুছতে মুছতে বলেন, স্বামীকে জীবিত ফিরে পেয়েছি সেই-ই অনেক।
আবু তালেবের মুখে শোনা হলো মরুর বুকে তার স্বপ্নভঙ্গের গল্প।

আবু তালেব জানান, যার কাছ থেকে ভিসা নিয়ে সৌদি আরবে গেছি, সেও বাঙালি। নিকটাত্মীয়ও। সেখানে দোকান কর্মচারীর ভিসা দিয়ে আমাকে নিয়ে যায়। ৭ লাখ টাকার মধ্যে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে ভিসার জন্য তাকে দেয়া হয় ৪ লাখ টাকা। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি আমার কোনো কাজ নেই। থাকা ও খাওয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। তার উপর বাকি ৩ লাখ টাকার জন্য চাপ।

একপর্যায়ে থাকা ও খাবার-দাবার না পেয়ে এবং টাকা দেয়ার ভয়ে পালিয়ে যাই মরুভূমিতে। সেখানে এক পাকিস্তানি নাগরিকের দয়ায় উট চড়ানোর কাজ জুটে। বেতন মাসে ৭০০ রিয়াল। বেঁচে থাকার তাগিদে সে কাজ করলেও সে টাকায় থাকা-খাওয়ার খরচও হয় না। স্ত্রী-সন্তানসহ সবার সঙ্গে যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন। কি এক দুঃসহ জীবন। প্রায় চার মাস পর লুকিয়ে এক জায়গা থেকে বাড়িতে ফোন করি। কণ্ঠ শুনেই স্ত্রীর সে কী কান্না। কথা তেমন আর বলা হলো না।

আবু তালেব বলেন, ফোনে স্ত্রীকে আমি বলেছি আমার পালিয়ে যাওয়া ও কষ্টের কথা। স্ত্রী বলছে, এনজিওর কিস্তি ও ধারদেনার কথা। সংসার খরচের কথা। এভাবে দুই-তিনমাস পর পর ফোনে কথা হলেও স্ত্রীর কাছে টাকা পাঠাতে পারিনি। তারা খাচ্ছে কি? চলতি অক্টোবর মাসের শুরুর দিকে সৌদি পুলিশের হাতে ধরা পড়ি। হাত ও পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি দিয়ে থানায় নিয়ে আসে। সেখান থেকে কারাগার। সেখান থেকে আদালত, শেষে বিমানে তুলে দিলে কোনোরকমে প্রাণে বেঁচে ফিরি।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মৃত আবদুল মজিদের ছেলে মহিউদ্দিনের স্বপ্নভঙ্গের কথা আরও করুন। তিনিও সৌদি আরব গিয়েছিলেন দোকান কর্মচারীর ভিসায়। সৌদি গিয়ে দেখেন কফিলের কর্মচারীর অনুমোদন আছে তিনজনের। তিনি ভিসা বিক্রি করেছেন ১০ জনের কাছে। মহিউদ্দিন আর ওই নির্ধারিত কফিলের অধীনে কাজ করা হয়নি। ওখান থেকে পালিয়ে অন্য দোকানে কাজ নিলেন, যা সৌদি আইনে অবৈধ।

মহিউদ্দিন বলেন, পালিয়ে একটি দোকানে মোবাইল ফোন মেরামতের কাজ নেই। প্রথমে কষ্ট হয়েছে। যেহেতু প্রায় ছয় লাখ টাকা খরচ করে গিয়েছি, টাকা তো তুলতে হবে। কষ্ট করে থেকে গেলাম। পুলিশ তল্লাশি করতে আসলে লুকিয়ে থাকতাম। একবার গ্রেপ্তারও হয়েছি। দুই হাজার রিয়াল জরিমানা দিয়ে ছাড়া পাই। শেষে গত মে মাসে গ্রেপ্তার হই। গ্রেপ্তার হওয়ার পর হাতে হাতকড়া, পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে এসে দেশে পাঠিয়ে দেয়। পরনের কাপড় ছাড়া কিছুই আনতে পারিনি।

চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার সরল ইউনিয়নের মফিজুর রহমানের ছেলে মুজিবুর রহমান। অন্য দু’চারজন প্রবাসীর মতো তিনিও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য ধারদেনা করে পাড়ি জমান সৌদি আরবে।

মুজিবুর রহমান বলেন, স্থানীয় একটি ব্যাংকে পৈতৃক ভিটেবাড়ি বন্ধক রেখে ঋণ নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্সে সৌদি আরবের জেদ্দায় গিয়েছিলাম। ভিসা দিয়েছেন আমার আপন চাচাতো ভাই। সৌদি আরব যাওয়ার পর দেখি যে কফিলের অধীনে ভিসা হয়েছে, তার কোনো হদিস নেই। এক মাস অপেক্ষা করেছি, কফিল (ভিসা প্রদানকারী সৌদি নাগরিক) আমাকে রিসিভ করতে আসেননি।

মুজিব জানান, আমি একজন কফিল ম্যানেজ করি। কফিল আমার মেডিকেল টেস্ট করালেন। রিপোর্ট আসলো আমি আনফিট। আমার হার্ট আর কিডনিতে সমস্যা আছে। মেডিকেল ফিট সার্টিফিকেট করাতে ৪ হাজার সৌদি রিয়াল দাবি করলেন। ৪ হাজার রিয়াল দিতে না পারলে বেতন ছাড়া পেটে-ভাতে কাজ করার সুযোগ দিতে ইচ্ছুক হলেন সেই কফিল।

এভাবে একমাস কাটলো কর্মহীন। চলছিলাম অর্ধাহারে-অনাহারে। বাড়িতে ঋণের কিস্তির সময়ও ঘনিয়ে আসছিলো। তখন সৌদি আরবের রিয়াদ শহরে শ্বশুরবাড়ির এক আত্মীয়ের কাছে পালিয়ে যাই। রিয়াদে ওই আত্মীয় একটা কাজের ব্যবস্থা করে দিলেন। মাসিক এক হাজার ৭০০ রিয়াল বেতনে। ৩ মাস পরপর বেতন দেবে ওই মালিক কথা ছিল এমনই। প্রথম ৩ মাস কাজ করার পর ৫ হাজার ১০০ রিয়াল বেতন পেয়েছি।
শেষ ৩ মাসের বেতন তোলার আগেই একদিন ভারতীয় শ্রমিক আর বাঙালিদের মাঝে গণ্ডগোল বাধলো। আমি মসজিদে ছিলাম। মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর বাঙালি-ভারতীয়রা মিলে আমিসহ ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করলো। আমাদের থানায় নিলো। থানা থেকে কারাগারে। আবার কারাগার থেকে থানায়। এভাবে ১৪ দিন কেটে গেল। যেদিন দেশে পাঠাবে সেদিন পরনের প্যান্টের বেল্টটিও খুলে নিয়েছে সৌদি পুলিশ। অথচ সৌদিতে কাজ করার জন্য আমার আকামা ছিল, ভিসার মেয়াদও ছিল।

বিদেশ যেতে হলে দেশ থেকে মেডিকেল টেস্ট করিয়ে ফিটনেস সার্টিফিকেট এবং যে ভিসায় যাবেন সে বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু আপনি এটা কেন অনুসরণ করেননি? মুজিব জানান, ভিসা দিয়েছেন আমার আপন চাচাতো ভাই। ওরাই বারবার বলেছেন মেডিকেল টেস্ট করাতে হবে না। মেডিকেল টেস্ট করানোর রেফারেন্স তো ভিসা দাতারা দেন। আমার ক্ষেত্রে তা হয়নি। তাই আমিও করাইনি, কন্ট্রাক্টে গিয়েছি।

এভাবে আবু তালেব, মহিউদ্দিন ও মুজিবের মতো হাজার হাজার প্রবাসী অনেক গ্লানি নিয়ে দেশে ফিরেছেন। যাদের মধ্যে চট্টগ্রামের শত শত প্রবাসীও রয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে মানসিক যন্ত্রণায় দিন পার করছেন তারা।

এ বিষয়ে ব্র্যাকের অভিবাসন শাখার প্রধান শরিফুল ইসলাম বলেন, আত্মীয়দের মাধ্যমে ভিসা নিলেও ওই ভিসা দালালের কাছ থেকে নেয়া। তাই যারা বিদেশ যাবেন তারা দালালের কাছ থেকে ভিসা কেনার বিষয়ে অবশ্যই সাবধান থাকতে হবে। সরকারিভাবে যদি উনারা রিক্রুট হতেন তবে সরকার বিষয়টি সৌদি সরকারকে অবহিত করতে পারতেন। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারেরও আইনি বাধা আছে। দালাল ধরে যাওয়া ভিসার ব্যাপারে সরকারেরও কিছু করার থাকে না।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.