Beanibazarview24.com
‘ব’ডি কন্ট্রাক্ট’ শব্দ দুটি বেশিরভাগ মানুষের কাছে অপরিচিত। তবে যারা ইউরোপ, আমেরিকায় কিংবা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবৈধ উপায়ে কাজ করতে যান তাদের কাছে বেশ পরিচিত এই শব্দ যুগল।
এটি মূলত: একটি চুক্তির নাম। যারা বৈধ কাগজপত্র ছাড়া প্রবল ঝুঁকি নিয়ে বিদেশে কাজ করতে যান তারাই এই পদ্ধতি অবলম্বন করেন। এই মুহূর্তে চুক্তিটি বেশ রমরমা বলা যায়।
বিদেশে যাবার জন্য প্রাণের মা’য়া ত্যা’গ করে চরম ঝুঁকি নেন একজন মানুষ। এতে কেউ সাগরে ডুবে প্রাণ হারান, কেউ সীমান্ত পার হতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে নির্যা’তনের শি’কার হন, আবার কেউ পড়েন অপহ’রণকারীর খপ্পরে। তবে ভা’গ্যক্রমে অনেকে এভাবেই পৌঁছে যান প্রতিশ্রুত গন্তব্যে।
বডি কন্ট্রাক্ট কী?
এই ‘ব’ডি কন্ট্রাক্ট’ বা শরীর চুক্তির মানে হলো একজন এজেন্ট তখনই হাতে টাকা পাবে, যখন একজন শ্রমিক প্রতিশ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাবেন। অর্থাৎ একজন বিদেশ গমনেচ্ছু ব্যক্তিকে গন্তব্যে পৌঁছে দেয়া হবে এটাই এই চুক্তির প্রধান শর্ত, পৌঁছালে টাকা তুলে দিতে হবে এজেন্টের হাতে।
গন্তব্যে পৌঁছাতে না পারলে কোন টাকা দিতে হবে না। তবে প্রতা’রিত হয়ে দেশে ফিরলে অনেক সময়ই এজে’ন্ট বা দা’লাল বা পা’চারকারী অর্থ ফেরত দেন না। এখানে প্রধান বিষয় হচ্ছে, ব’ডি কন্ট্রাক্ট হয় অবৈ’ধভাবে অনিশ্চিত রুটে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে।
কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের এক এজেন্ট রবিউল আহমেদ, যিনি তার প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কন্ট্রাক্ট ভিসা মানে হলো ভিসা পাবার আগে যাবতীয় খরচ এজেন্টের’।
‘অর্থাৎ ভিসা ফি, স্পন্সর, বিমান ও স্থল বা নৌপথে পরিবহনের খরচ ভাড়া, বিভিন্ন চেকপয়েন্টে যেসব জায়গায় টাকা দিয়ে ঢোকার ব্যবস্থা করা হবে, সে সবই এজেন্ট দেবেন’।
তিনি জানান, টাকা পরে নেবার যুক্তি হচ্ছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন, কারণ ঠিক জায়গামত না পৌঁছাতে পারলে, পরে আর লোক পাওয়া যাবে না। দ্বিতীয়ত টাকা নিয়ে ব্যর্থ হলে, লোকে টাকা দেবে না পরে। ২০১৯ সালে এ পর্যন্ত ৯ জন মানুষকে এই চুক্তিতে তিনি আমেরিকা এবং স্পেনে পাঠিয়েছেন।
তিনি স্বীকার করেছেন, ব’ডি কন্ট্রাক্টে খরচ বেশি হয় বৈধ পদ্ধতির চেয়ে। ‘কারণ আপনার ঝুঁকিওতো বেশি। খালি ভিসা পাইলেই তো কেউ টাকা শোধ দেয় না, ওই দেশে ঢুকলে পরে টাকা দেয় আমাদের। আর যদি কোনোভাবে অ্যাক্সি’ডেন্ট হয় তাহলে টাকা তো পাবই না, উ’ল্টা পুলিশ কেস হয়।’
ঝুঁকি সম্পর্কে কতটা জানেন বিদেশ গমনেচ্ছু?
নোয়াখালীর সোনাইমুড়ি উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে প্রতি বছর বহু মানুষ ইউরোপ ও আমেরিকায় যায়। এদের বড় অংশটি যায় কন্ট্রাক্ট ভিসা বা যেটি স্থানীয়ভাবে বডি ক’ন্ট্রাক্ট নামে পরিচিত, সেই পদ্ধতিতে।
সোনাইমুড়ির রফিকুল ইসলাম (ছ’দ্মনাম) জানান, গত দুই বছর ব্যবসায় লোকসান করার পর তার পরিবার সিদ্ধান্ত নেয় তার ছোট ভাইকে বিদেশে পাঠানোর। এক বছর আগে তার ১৭ বছর বয়সী ছোটভাই এজেন্টের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে যাবার জন্য প্রথমে বাংলাদেশ থেকে বৈধ ভিসায় ব্রাজিলে যান।
‘এরপর দা’লাল (এজেন্ট) সেখান থেকে আরেক এজেন্টের কাছে হস্তান্তর করছে। তার মাধ্যমে কলম্বিয়া, কলম্বিয়া থেকে পানামা গেছে। পানামার মধ্যে আমাজন জঙ্গলের অংশটি হেঁ’টে পার হয়েছে আমার ভাই। অন্য সবখানে বর্ডার গা’র্ডদের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ছিল আমাদের দা’লালের। সেখান থেকে মে’ক্সিকো সীমান্ত হয়ে আমেরিকা ঢুকছে আমার ভাই’।
এই পথে কয়েক জায়গাতেই তার ভাই ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে, কয়েকদিন জেল খেটে বেরও হয়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পর তার ভাইকে সাত মাস জেল খাটতে হয়েছে, কিন্তু চাইল্ড প্রটেকশন আইনের আওতায় পরে একজন স্থানীয় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মুক্তি পেয়েছেন।
‘সবমিলে মোট ২৬ লাখ টাকা খরচ হয়েছে আমাদের। ব্রাজিল পর্যন্ত যেতে যে খরচ সেটা আমার ভাই দেশ ছাড়ার আগেই দিতে হয়েছে, সেইটা দুই লাখ বা তিন লাখ টাকা।
এরপর সেখান থেকে কলম্বিয়া যাবার পর দা’লালকে দুই লাখ টাকা, কলম্বিয়া থেকে পানামা যাওয়ার পর দিয়েছি তিন লাখ টাকা এভাবে ধাপে ধাপে একেকটা জায়গায় পৌঁছানোর পর টাকা পরিশো’ধ করেছি আমরা’।
তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ঢোকার পরে একজন স্থানীয় অভিভাবকের তত্ত্বাবধানে মুক্তি পাওয়ার জন্য ওই ব্যক্তিকে, যিনি তাদের এজেন্টের পূর্ব পরিচিত, তাকে দশ লাখ টাকা দিতে হয়েছে।
‘এক বছর আগে আমার খালাত ভাই গেছে, সে ভালো আছে, যে কারণে আমরা সাহস করলাম। আর আমেরিকা যাইতে তো অত ঝুঁ’কি নাই, কারণ একমাত্র পানামার উপকূল ছাড়া কোনো নৌপথ নাই, তাই আমরা অতটা টেনশন করিনি’। আমার ভাই ভাগ্যবান। সবাই তার মত নন।
তবে আছে অনেক খা’রাপ খবর। যেমন এ বছরের মে মাসে লিবিয়া থেকে ছোট্ট নৌকায় চেপে খুবই বিপদংসকুল পথে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে পৌঁছানোর চেষ্টা করতে গিয়ে নৌকাডু’বিতে মা’রা গেছেন অন্তত ৪০ জন বাংলাদেশি।
বাংলাদেশ থেকে যেসব দেশে শ্রমিকেরা কাজ করতে যায়, ব’ডি কন্ট্রাক্টে সেই সব দেশেই লোক পাঠায় এজেন্টরা।
এর মধ্যে লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি, স্পেন ও গ্রিসসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, বাহরাইন, লিবিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ অনেক দেশেই শ্রমিক পাঠায় এজেন্টরা।
‘উন্নত জীবনের আশার পৃথিবীর সব দেশ থেকেই মানুষ উন্নত দেশে যেতে চায়, কয়েকদিন আগে আমরা যুক্তরাজ্যেও দেখলাম লরিভর্তি ম’রদে’হ পাওয়া গেছে। কিন্তু এক্ষেত্রে জনগণকে সচেতন করা এবং অনিয়মের ক্ষেত্রে শা’স্তি নিশ্চিত করার জন্য সরকারকে দায়িত্ব নিতেই হবে’।
এ বছরের জুনে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর এক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে, যাতে দেখা যায়, ভূমধ্যসাগর ব্যবহার করে ইউরোপে প্রবেশকারীর সংখ্যায় বাংলাদেশিদের অবস্থান চতুর্থ।
গত সাত বছরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ যেতে গিয়ে প্রা’ণ” হা’রিয়েছেন প্রায় সাত হাজার বাংলাদেশি। নিখোঁ’জ রয়েছেন সাড়ে ১২ হাজারের বেশি মানুষ।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.