Beanibazarview24.com
বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন জ্বলছে। প্রাণে বাঁচতে ভবনের নয়তলা থেকে তার বেয়ে নামার চেষ্টা করেন এক তরুণী। এই দৃশ্য দেখে তাঁকে থামতে বলেন এক যুবক। এরপর জীবনের পরোয়া না করে স্পাইডারম্যানের মতো দ্রুত দেয়াল বেয়ে ওপরে উঠে পড়েন। তরুণীকে একতলা নিচে নামিয়ে নিরাপদে পাশের ভবনে নিয়ে যান।
গত ২৮ মার্চ এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের পর জীবন বাঁচানোর এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল। অনেকেই ভিডিওটি দেখেছেন। সবাই উদ্ধারকারী যুবকের প্রশংসা করেছেন। জানতে চেয়েছেন তাঁর পরিচয়।
সেই যুবকের নাম মো. জসিম। বয়স মাত্র ৩১। গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলায়। থাকেন গুলশানের কড়াইল বস্তিতে। বিয়ে করেছেন। সংসারে স্ত্রী ও দুই ছেলে আছে।
জসিম বনানীর হাওয়া ভবন মাঠে পুরোনো আসবাবপত্র কেনাবেচার ব্যবসা করেন। পাশাপাশি সেই মাঠের সোয়াট ক্লাবে ফুটবলও খেলেন তিনি। দলের ম্যানেজারেরও দায়িত্ব পালন করেন।
জসিম কী করেছিলেন সেদিন
গত ২৮ মার্চ দুপুরে এফ আর টাওয়ারে লাগা ভয়াবহ আগুনে এখন পর্যন্ত ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
আগুন লাগার সময় প্রতিদিনের মতো নিজের পুরাতন আসবাবপত্র কেনাবেচার স্থানে বসেছিলেন জসিম। তখন এক রিকশাওয়ালার মাধ্যমে খবর পান, দুপুর ১২টা ৪০ মিনিটে এফ আর টাওয়ারে আগুন লেগেছে। দ্রুত দৌড়ে এফ আর টাওয়ারের সামনে পৌঁছে যান জসিম। এরপর কী হয়েছে-সে ব্যাপারে এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে কথা বলেছেন জসিম।
জসিম বলেন, ‘এফ আর টাওয়ারের সামনে গিয়ে দেখি আটতলার বামপাশে আগুন লাগছে। তাপে আটতলার জানালার থাই গ্লাস ভেঙে নিচে পড়ছে। নিচ থেকে দেখা যাচ্ছে, আগুনের দাহ। সে সময় পর্যন্ত আটতলা উঁচুতে পানি দেওয়ার মতো ফায়ার সার্ভিসের কোনো ক্রেন আসেনি। আমি ভাবছি, দেখি কিছু করা যায় কি না, মানুষগুলোকে কিভাবে বাঁচানো যায় এই আগুন থেকে। কিন্তু আটতলায় ওঠার মতো কোন ব্যবস্থা নেই।
সমস্ত জায়গায় আগুন ছড়িয়ে গেছে। টাওয়ারে থাকা মানুষের আর্তনাদ দেখে মন মানছিল না। তাই নিজের কথা চিন্তা না করে ছুটে যাই টাওয়ারের কাছে। দেখি, আমার এক বন্ধু, নাম লোকমান। বাঁশ লাগিয়ে তারের ওপর বসে আছে। তখন আমি চিন্তা করলাম, আগুন যতটুকু জায়গায় ছড়িয়েছে, এ অবস্থায় আমি যদি আটতলায় গিয়ে পানি দিতে পারি তাহলে আগুন নেভানো যাবে। তাই লোকমানকে বলি, আমি উপরে যাচ্ছি, আমাকে পাইপ তুলে দিস। পরে ফায়ার সার্ভিসের পানি ভর্তি পাইপটি নিয়ে কষ্ট করে দুজনে টেনে দোতলা পর্যন্ত উঠাতে গিয়ে দেখি পানিসহ আমি নিচে নেমে যাচ্ছি। তখন পাইপটা ছেড়ে দেই।
ঠিক সেই সময়, উপরে তাকিয়ে দেখি, এক আপু নয়তলা থেকে ফোন ও ডিশের তার বেয়ে নিচে নামছিলেন। তখন আমি চিন্তা করলাম, আপু তো পড়ে যাবে। আমি তাঁকে বললাম, আপনি আর নামবেন না। আমি আসছি। বলতে বলতে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার বেয়ে আটতলায় নেমে কাঁপতে থাকেন। আমি তড়িঘড়ি করে দেয়াল বেয়ে আটতলায় পৌঁছাই। তাঁকে এসি রাখার একটি লোহার স্ট্যান্ডে দাঁড় করিয়ে ডান দিকের দেয়ালে পা রেখে আমার পায়ের ওপর ভর দিয়ে ও তার ধরে পাশের ভবনের গ্রিল ধরতে বলি।
তিনি আমার কথা মোতাবেক কাজগুলো করায় পরে আমি সেই ভবনের জানালা ধরে আপুকে টেনে ভেতরে প্রবেশ করাতে সক্ষম হই। এরই মধ্যে বন্ধু লোকমানও উপরে উঠে নিচ থেকে ওই আপুকে ধরতে সাহায্য করে। ওই আপুকে হেফাজতের সাথে পৌঁছে দিয়ে আমি বন্ধু লোকমানকে বলি, তুই একটু দাঁড়া। আমি দেখে আসি আর কাউকে এমন বিপদ থেকে বাঁচাতে পারি কি না।’ বলছিলেন জসিম।
ওই ঘটনার পর ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ক্রেন নিয়ে এসে উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করে। আগুন নেভানো ও উদ্ধার কাজে যোগ দেয় ফায়ার সার্ভিসের ২০টি ইউনিট। সহযোগিতা করে পুলিশ, সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা।
এদিকে দুঃসাহসী ও জীবন বাঁচানো কাজ করলেও গণমাধ্যমের আড়ালে ছিলেন জসিম। তাঁর ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পরও তিনি নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি চাননি আগুনের সময় ফায়ার সার্ভিসের পাইপ ধরে খ্যাতি পাওয়া শিশু নাঈমের মতো হতে। নাঈমকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মানুষের কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও বিষাক্ত মন্তব্যে তাঁকে আতঙ্কিত করে তোলে।
এই কারণে অনেক কষ্টে জসিমের সন্ধান পাওয়া যায়। গতকাল সকালে কড়াইল বস্তিতে তাঁর বাড়িতে গিয়ে কথা হয় এনটিভি অনলাইনের এই প্রতিবেদকের।
সেদিনকার ঘটনা প্রসঙ্গে জসিম বলেন, সবাইকে বাঁচাতে পারলে তাঁর আনন্দ হতো। কিন্তু অনেক মানুষ মারা যাওয়ায় সেই দিনটি তাঁর কাছে একটি শোকের দিন।
তাঁর কোনো ধরনের সহযোগিতা লাগবে না জানিয়ে জসিম বলেন, ‘টাকাপয়সা লাগব না ভাই, পঁচাইয়েন না।’
শৈশবেই বাবাকে হারান জসিম
১৯৯৩ সালে শেরপুর থেকে রাজধানী ঢাকায় কাজের খোঁজে আসেন জসিমের বাবা কুমুর আলী। তখন জসিমের বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। ১৯৯৬ সালে টানা ২১ দিন হরতালে দূরপাল্লার কোনো যানবাহন না চলায় কুমুর আলী ট্রাকে করে ঢাকায় ফিরছিলেন। ট্রাকটি ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলায় আসামাত্র খাদে পড়ে যায়। ট্রাকে থাকা মালামালের চাপে সেখানেই কুমুর আলীর মৃত্যু হয়। তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তেন জসিম।
বাবাকে হারিয়ে জসিম ও তাঁর ভাই আবদুল কাদের এবং তাঁদের মা মাজেদা রোজ ৬০ টাকা মজুরিতে ইট ভাঙার কাজ শুরু করেন। বয়স কম হওয়ায় রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে সারা বেলা ইট ভাঙতে কষ্ট হতো শিশু জসিমের। শিশু হওয়ায় মজুরিও কম ছিল। দিনশেষে মা ও দুই ভাই মিলে সারা দিনে ১৫০ টাকা উপার্জন করে সংসার চালাতেন। বাসায় থাকত আরেক ছোট ভাই আজিম ও বোন সাথি।
কথাগুলো বলছিলেন জসিমের বড় ভাই আব্দুল কাদের।
২০০৯ সালে ব্র্যাক থেকে কিস্তিতে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে কড়াইল বস্তিতে থাকার জন্য একটা ঘর তোলে জসিমের পরিবার। শৈশবে ইট ভাঙার কাজ করার পরে কৈশোরে এসে জসিম ইলেকট্রনিকসের দোকান, গার্মেন্টস ও সোয়েটার তৈরির কারখানা, ওষুধের কারখানাসহ বিভিন্ন স্থানে চাকরি করে। বর্তমানে তার বড় ভাই মো. আব্দুল কাদের সোয়াট মাঠের পাশে একটি চায়ের দোকান পরিচালনা করেন। ছোট ভাই আজিম বনানীতে একটি বিকাশ, মোবাইল রিচার্জের দোকান চালান।
ভিডিওটি দেখতে চাইলে এখানে ক্লিক করুন…
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.