Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

প্রথম বাংলাদেশি নারী নুসরাত যিনি অশনাক্ত লাশের পরিচয় বের করেন







সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে সহকারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট হিসেবে চাকরি করেন নুসরাত ইয়াসমিন। তিনি এই পেশায় বাংলাদেশের প্রথম নারী। অশনাক্ত লাশের পরিচয় গবেষণার মাধ্যমে বের করেন। এফবিআই তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে।

পুলিশ বা যেকোনো বিভাগের ‘ফরেনসিক ডিএনএ এক্সপার্ট’ হতে চেয়েছিলাম। (ফরেনসিক মানে হলো খুন, বিষপ্রয়োগে হত্যাকা- ইত্যাদি বিষয়ে মামলায় প্রয়োজনীয় চিকিৎসাবিদ্যা; ডিএনএ ‘ডিআক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড’ হলো কোষের ভেতরে থাকা জৌব রাসায়ণিক অণু। এটি মানুষের বৃদ্ধি, উন্নতি ইত্যাদিতে প্রয়োজনীয় জেনেটিক নির্দেশক; ‘এক্সপার্ট’ মানে বিশেষজ্ঞ) আকর্ষণটি বায়োকেমিস্ট্রি (প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান) বিভাগে পড়ার কারণে হয়েছে। বিভাগে ফরেনসিক ডিএনএ পড়ানো হয়, শিক্ষক শরীফ আখতারুজ্জামান। তিনি এ বিষয়ের পথপ্রদর্শক।



বাংলাদেশে ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ে তাকে ‘জনক’ বলা হয়। এখনো তিনি পড়ান। যখন পড়াতেন, তখন থেকে বিষয়টিকে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো। এটি এমন এক পদ্ধতি যেটি থেকে জ্ঞানটি সরাসরি মানুষের উপকারে কাজে লাগানো সম্ভব হবে। ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, মামলা সমাধানে ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং মানুষকে এমন ফলাফল দেয়, যেটি নিয়ে কোনো দ্বিমত হয়নি। ফলে এ বিষয়ে কাজ করায় খুব আগ্রহ ছিল।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় থেকে ২০১২ সালে মাস্টার্স পরীক্ষা দিলাম। কোথাও চাকরির আবেদন করিনি। সে বছরের ডিসেম্বরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ চাকরির জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলো। আবেদন করলাম। দুজনকে নেওয়া হবে। মাস্টার্সের ফলাফল দেওয়া হলো। ২০১৩ সালের মার্চে বাবা কাজী ইদ্রিস আলী স্ট্রোক (মস্তিষ্কের হঠাৎ রোগে আক্রান্ত হয়ে চৈতন্য ও চলাচলের শক্তি লোপ পাওয়া) করলেন; তিনি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ফলিত রসায়ন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক। ১১ দিন হাসপাতালে ছিলেন। সার্বক্ষণিক তার সঙ্গে ছিলাম। খাওয়া, গোসল কিছুই হয়নি। চাকরির চিঠি গেলÑ লিখিত পরীক্ষা হবে। তৃতীয় বর্ষে ১শ নম্বরের থিওরি কোর্স খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। সেটি মনে আছে।



হাসপাতালে থাকায় এক রাত পড়ে পরদিন রাজারবাগ পুলিশ লাইনস স্কুলে পরীক্ষা দিতে গেলাম। ২০ মিনিটে সব লিখে ফেললাম। বাবা ও মায়ের কাছ থেকে ডিএনএ কতটুকু পাওয়া যায় এই ধরনের সাধারণ প্রশ্ন এলো। দুই-আড়াই মাস পরে ২৫-৩০ জনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মৌখিকের জন্য ডাক এলো। ভালো করলাম। মেডিকেল হলো। পাস করে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা হিসেবে ২০১৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বরে সিআইডি হেডকোয়ার্টার্সে পোস্টিং হলো। অপরাধ তদন্ত বিভাগের অধীনে ‘ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব’-এ যোগ দিলাম। আমরা সাতজন মিলে ল্যাবরেটরিটি শুরু করেছি। এখনো আমি আছি। চাকরি শুরুর পর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বিদেশি প্রশিক্ষকরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। ২০১৪ সালে প্রথম বিদেশে গেলাম। মালয়েশিয়ান রয়্যাল পুলিশের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ দিলেন। সাত জনের দলে আমিই মেয়ে। দুই সপ্তাহ থাকলাম। তারা ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং তৈরি করা শেখালেন। ‘আই ডোরা’ নামের বিখ্যাত এক প্রশিক্ষককে পেয়েছি। পরে যেসব বিশেষজ্ঞ এসেছেন, প্রত্যেকে তার নাম করেছেন। তারা কীভাবে মামলা পরিচালনা, গোপনীয়তা রক্ষা করেন শিখেছি।



সে শেখা মামলাগুলো তদন্তে কাজে লেগেছে। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে ভারতের গুজরাটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাতে প্রতিষ্ঠিত বিশে^র একমাত্র ‘গুজরাট ফরেনসিক সায়েন্স ইউনিভার্সিটি’তে প্রশিক্ষণে গেলাম। ওখানে বিষয়টিকে ভালো মূল্যায়ন করা হয়, তারা আরও মূল্যায়ন করতে চান। দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিলাম। আমাদের ডিএনএ ল্যাবের ১০ জন। আমি একাই মেয়ে। ও, সেই প্রশিক্ষণটি খুব ভালো ছিল। সেখানে যাওয়ার পর মনে হলো, আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমাদের সরকারি একটিই ডিএনএ ল্যাব। ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফরেনসিক ডিএনএ প্রশিক্ষক এলেন। ‘কোডিস (কমবাইন্ড ডিএনএ ইনডেক্স সিস্টেম)’ নামের ডিএনএ ডাটাবেইজড সফটওয়্যার আছে। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় ডিএনএ ডাটাবেইজ; এফবিআই তৈরি করেছে, পরিচালনা করে। তিনি দেখলেন, আমরা কোডিস ব্যবহার করতে পারব কি না। সপ্তাহ খানেকের বেশি থেকে প্রশিক্ষণ দিয়ে মান যাছাই করলেনÑ আমরা কোডিস ব্যবহার করার সক্ষমতা রাখি? এফবিআইয়ের সদস্যদের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ নিতে পারব? এরপর ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে এফবিআই থেকে দুজন ডিএনএ এক্সপার্ট এলেন, সঙ্গে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারÑ পুরো আইটি ও ডিএনএ গ্রুপ।



এ প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস একমাত্র ‘কোডিস’ প্রশিক্ষণ পাওয়া নারী ‘ডিএনএ অ্যানালিস্ট’ হিসেবে আমাকে অভিহিত করল। মানুষের ডিএনএ প্রোফাইলিং বা জীবনালেখ্য সংরক্ষণ, ৫-১০ বছর পরেও কাজে ব্যবহার, মামলা তদন্তে সাহায্য করা শিখলাম। এটি আমার জন্য বিরাট প্রশিক্ষণ। দেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্থা বার্নিকাট সিআইডিতে এসে নিজের হাতে আমাদের সার্টিফিকেট দিলেন। তাদের ভাষায় ‘গ্র্যাজুয়েশন’ করলাম। কোডিস ব্যবহারের স্বীকৃতিও পেলাম। মাত্র ৫১টি দেশে এটি ব্যবহার করে, এফবিআই পরীক্ষা করে তাদের সফটওয়্যার ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আমরা ৫১তম দেশ। ভারত কোডিস ব্যবহারের অনুমতি পায়নি। ২০১৮ সালের জুলাইতে ভারতের গুজরাটের ফরেনসিক সায়েন্স ইউনিভার্সিটিতে আবার প্রশিক্ষণে গেলাম। ১৬ দেশের বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিষয়ে বিচ্ছিন্নভাবে দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিলাম। এসব অভিজ্ঞতায় অনেক মামলায় কাজ করেছি।



হলি আর্টিজানের ঘটনায় যাইনি, আমাদের ল্যাব টিম ছিল। নেপালের দুর্ঘটনায় আমাদের ফরেনসিক এক্সপার্ট চিকিৎসকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। নিমতলী দুর্ঘটনায় ডিএনএ টেস্ট করার প্রয়োজন হয়নি। সব মৃতদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে।

২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে চকবাজারের দুর্ঘটনায় ৬৭ জন মারা গেলেন। আগে আমরা খুব বেশি ল্যাবের বাইরে বেরোতে চাইনি, যেতেও হয়নি। মানুষের সামনে আসিনি। চকবাজারের ঘটনায় মানুষের অনুভূতিকে সম্মান জানিয়ে বিরাট ইস্যুতে ডিএনএ ল্যাব থেকে বের হয়ে জনসম্মুখে আমাদের বুথ খুলেছি। ঢাকা মেডিকেলের মর্গের সামনে বুথ ছিল। সেই সূত্রেই আমাকে চিনে থাকবেন। যে মৃতদেহগুলো শনাক্ত করা যায়নি, যারা নিজেদের তাদের মানুষগুলোর আত্মীয় হয়ে থাকতে পারেন বলে দাবি করেছেন, তাদের কাছ থেকে ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে গবেষণাগারে গবেষণা করে মিলিয়েছি।

প্রত্যেক মানুষের চোখে পানি, কান্না দেখেছি। দুদিন ধরে নমুনা সংগ্রহ করা দলের আমি প্রধান ছিলাম। দ্বিতীয় দিন সকাল ৮টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত টানা ঢাকা মেডিকেলের সামনে দাঁড়িয়ে কাজ করেছি। দুপুরের খাবারের জন্যও বেরুতে পারিনি। অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছেÑ পাঁচ বছরের এক শিশু মাকে হারিয়েছে। তার রক্তের নমুনা নেওয়ার সময় খুব কাঁদছিল। পুরো দল তার পাশে দাঁড়িয়ে তাকে শান্ত করেছি, ভয় ভাঙিয়েছি। পরে নমুনা নিয়েছি। অনেকে স্বজনের খোঁজে এসেছেন। স্বজনকে পেতে নমুনা দিতে সাহায্য করেছেন। একটি মেয়ের কথা ডায়েরিতে নোট দিয়েছিÑ মেয়েটি তার বাবাকে খুঁজে পাচ্ছে না। রক্ত নিতে গেলে কাঁদছিল, ‘সুই দিতে গেলে ব্যথা পাব।’ তার মা বলেছেন, ‘এই ব্যথা আর কী? তোমার বাবা কত কষ্ট করে মারা গেছেন চিন্তা করো।’ ১২ বছরের মেয়েটি আর কথা বলেনি। আরেক মাকে বলেছি, সুই দেব, ব্যথা পাবেন। তিনি বলেছেন, ‘এ আর কী ব্যথা? বুকের ভেতরে যে ব্যথা তার ওপরে কোনো ব্যথা নেই।’ শেষ দিকে যেসব শরীর পুড়ে বিকৃত হয়ে গেছে বলে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি, সেগুলো ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ে শনাক্ত করে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা ১৫টি শরীর সেভাবে হস্তান্তর করেছি।

নমুনা নিয়ে ফিরে টানা ১ মাস খাটতে হয়েছে। শুক্র, শনিও বাদ যায়নি। এই দুর্ঘটনা ২১ ফেব্রুয়ারি ঘটেছে। ২২, ২৩ শুক্র, শনিবার ছিল। আমরা অফিসে কাজ করেছি। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের বন্ধে অফিসে ছিলাম। ৯টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পুরো টিম কাজে ব্যস্ত ছিলাম। একটি লাশ বারবার গণনা করা হয়েছিল। কোডিস ডাটাবেইসের মাধ্যমে আমরা সেটিকে লাশের বিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে শনাক্ত করেছি। বেশকটি পূর্ণ, বিচ্ছিন্ন শরীরের অংশকে কোডিসের মাধ্যমে বের করেছি। এ সার্ভার মিল-অমিল, শরীরের এক অংশের সঙ্গে অন্যটিকে মেলানোর কাজ করে দেয়।

চকবাজারে অগ্নি দুর্ঘটনায় অশনাক্ত লাশগুলোর শনাক্ত করার পুরো রিপোর্ট আমার করা। বনানী দুর্ঘটনার সময় অফিসে ছিলাম। বৃহস্পতিবার বিকেল, সন্ধ্যায় আগুন জ¦লেছে। তখনো আমাদের কাছে নির্দেশনা আসেনি। ভেবেছি, লাফিয়ে পড়া মানুষ, আহত হওয়া মানুষ মারা যাবেন। রাতে সিআইডি থেকে নির্দেশনা এলোÑ স্ট্যান্ডবাই। পরদিন শুক্রবার সাড়ে ৮টায় বাসা থেকে বের হয়ে ঢাকা মেডিকেলে গেলাম। লাশ হস্তান্তর করা হচ্ছিল। তারা জানালেন, অশনাক্ত লাশ নেই, আত্মীয়-স্বজনরা নিয়ে গেছেন। সিআইডির পুলিশ সুপার স্যারের সঙ্গে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে গেলাম। সেখানেও অশনাক্ত লাশ নেই। আরও কিছু লাশ ছিল বলে ইউনাইটেড হাসপাতালে গেলাম। অশনাক্ত লাশ পাইনি। সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবে ‘হিউম্যান আইডেনটিফিকেশন’ মানে মানুষ শনাক্তের কাজ করা হয়। প্রত্যেকের আঙুলের ছাপ যেমন অনন্য, তেমনি প্রতিটি মানুষের ডিএনএ আলাদা। আমরা পরিচয় শনাক্ত করার কাজ করি। সড়ক দুর্ঘটনা, পানিতে ডোবা, খুন, কাটা অংশ, হাত-পা থেকে তার পরিচয় বের করি।

‘বাংলাদেশ ডিএনএ আইন-২০১৪’ অনুসারে উচ্চ আদালতের আদেশে থানা বা কোর্টে যে মামলা করা হয়, সেগুলোর কাজ করি। পুলিশ যে লাশগুলোর পরিচয় শনাক্ত করতে পারে না, সেগুলো আমাদের কাছে আসে। ফরেনসিক ডিএনএ মামলার তদন্তে, সমাধানে, অপরাধ দমনে বিশাল ভূমিকা রাখে। উন্নত সব দেশেই এই ল্যাব খুব শক্তিশালী। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে আমাদের ল্যাব খুব ভালো।

আমাকে পদ্মা ব্যাংক বাংলাদেশের প্রথম নারী ডিএনএ অ্যানালিস্ট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
সূত্রঃ দেশ রুপান্তর

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.