Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

একটি শূন্য কবর : যেটাকে ভয় পায় পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রও







কাহিনীটি একটি শূন্য কবরের। ওই কবরে একটা বড় শিলালিপি রয়েছে। এতে একটি নামও উৎকীর্ণ রয়েছে। তবে যার নামে এ কবর তৈরি করা হয়েছে, তার অস্তিত্ব থেকে এ কবরকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। এটা এমন এক মানুষের কাহিনী, যাকে মৃত্যুর পরও কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে। কবর তার লাশের অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। এটা শুধু একটি শূন্য কবরের কাহিনী নয়, বরং একটি লাশ বন্দী করার কাহিনী। এটা ভীত পারমাণবিক রাষ্ট্রের শক্তিশালী বাহিনীর পরাজয়ের কাহিনী; যারা শুধু জীবিত মানুষ নয়, মৃত মানুষকেও বন্দী করে রাখে। এটা কাশ্মিরের শহীদ মকবুল বাটের কাহিনী। তাকে ১৯৮৪ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দিল্লির তিহার কারাগারে ফাঁসি দিয়ে ওই কারাগারের ভেতরেই দাফন করা হয়।



ভারতের রাষ্ট্রপক্ষ মকবুল বাটের দেহকে নিজেদের কারাগারে দাফন করে মূলত কাশ্মির সমস্যাকে দাফন করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রাষ্ট্রীয় এ জুলুম তার সফলতায় রূপ নেয়। মকবুল বাটের ফাঁসি অধিকৃত জম্মু-কাশ্মিরে ভারতের জোরজবরদস্তিপূর্ণ দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির এক নতুন আন্দোলনের সূচনায় রূপ নেয়। এটা একটা শূন্য কবর নয়, বরং সুদীর্ঘ রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের কাহিনী। সত্য সর্বদা তিক্ত হয়। আর মকবুল বাটের কাহিনী একটি নয়, দু’টি রাষ্ট্রের নিপীড়ন সম্পর্কে তিক্ত সত্যে ভরপুর। একদিকে ছিল নিপীড়ক, অপরদিকে ধোঁকাবাজ শাসক। মকবুল উভয়ের পক্ষ থেকে আঘাত পেয়েছেন। তবে তিনি উত্তরসূরিকে এ পয়গাম দিয়েছেন যে, পাকিস্তানি শাসকেরা কাশ্মিরিদের ধোঁকা দিয়েছেন, তবে পাকিস্তানের জনগণের ওপর সর্বদা ভরসা রাখবে।



সম্ভবত এর কারণ ছিল, মকবুল বাটকে যখনই পাকিস্তানি রাষ্ট্রপক্ষ কারাগারে নিক্ষেপ করেছে, তখনই জনগণ তার মুক্তির দাবিতে সোচ্চার হয়েছে এবং পাকিস্তানের আদালত তাকে মুক্তি দিয়েছে। মকবুল বাটের কাহিনী পাকিস্তানের জনগণের পক্ষ থেকে তার প্রতি ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততার কাহিনী। এর সূচনা হয় ১৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩৮ সালে জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের কুপওয়ারা জেলার হান্দওয়ারা তেহসিলের ত্রেহগাম গ্রামে। সেখানে এক দরিদ্র কৃষক গোলাম কাদের বাটের ঘরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি যখন আট বছরের বালক, ওই সময় তার এলাকার এক জায়গিরদারের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়েন। শ্রীনগরের সেন্ট জোসেফ স্কুলে ছাত্র থাকাকালে তিনি স্বাধীনতার পক্ষে বক্তৃতা করতেন এবং পুলিশ তার সন্ধানে অভিযান চালাত।



এ জন্য তিনি বিএ পরীক্ষা দিয়ে চাচা আজিজ বাটের সাথে পেশোয়ার চলে আসেন। এখানে তিনি পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উর্দু বিষয়ে এমএ করেন। এখানে সে সময়ের বড় কবি আহমদ ফারাজের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়। মকবুল পেশোয়ারের দৈনিক আঞ্জামে সাংবাদিকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। বাঙ্গে হরম পত্রিকাতেও কাজ করেছেন। উইকলি খায়বার নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক বের করেছিলেন। মকবুল বাট কায়েদে আজমের সাবেক সচিব ও আজাদ কাশ্মিরের সাবেক প্রেসিডেন্ট কে এইচ খুরশিদের খুব কাছের মানুষ ছিলেন এবং তারই কথামতো তিনি স্বাধীন কাশ্মিরের দাবিতে রাজনীতিতেও অংশগ্রহণ করতে শুরু করেন। খুরশিদ মূলত ফাতিমা জিন্নাহর খুব কাছের মানুষ ছিলেন। জেনারেল আইয়ুব খান যখন ফাতিমা জিন্নাহর ব্যাপারে ধৃষ্টতামূলক আচরণ শুরু করেন, তখন কে এইচ খুরশিদ আজাদ কাশ্মিরের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেন।



মকবুল বাটের মন রাজনীতির প্রতি দ্রুত বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। ৪ এপ্রিল, ১৯৬৫ সালে তিনি আব্দুল খালেক আনসারি, জি এম লোন, আমানুল্লাহ খান ও গোলাম মুহাম্মদ জাররাহকে সাথে নিয়ে জম্মু-কাশ্মির প্লেবিসাইট ফ্রন্ট গঠন করেন (পরে নাম পরিবর্তন করে জেকেএলএফ হয়)। তারা সবাই শিয়ালকোট ও জম্মুর সীমান্তে অবস্থিত সুচিত গড় এলাকার সন্নিকটে যান এবং অধিকৃত জম্মুর মাটি নিয়ে সবাই মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেন। এ সংগঠনের সশস্ত্র শাখা হিসেবে গোপনে ‘ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠন করা হয়। অপারেশন জিব্রাল্টারের কারণে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হলো। ওই অপারেশন ব্যর্থ হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, স্থানীয় কাশ্মিরি নাগরিকেরা পাকিস্তান থেকে আগন্তুকদের পাশে এসে দাঁড়ায়নি।’ মকবুল সিদ্ধান্ত নেন, কাশ্মিরের স্বাধীনতার জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিবর্তে নিজের শক্তি পরখ করবেন। তিনি ১০ জুন, ১৯৬৬ সালে তার চারজন সঙ্গীকে সাথে নিয়ে অধিকৃত কাশ্মিরে প্রবেশ করেন। সশস্ত্র কার্যক্রম শুরু করলে স্থানীয় জনগণ স্লোগান দিয়ে তাদের পাশে এসে দাঁড়ায়।



কিছুকাল পরে তিনি তার সঙ্গী সুবেদার কালা খান ও মীর আহমদসহ গ্রেফতার হন। ১৯৬৮ সালের আগস্টে স্থানীয় বিচারক নীলকণ্ঠ গাঞ্জু সিআইডি কর্মকর্তা অমরচাঁদ হত্যার অভিযোগে তাকে ফাঁসির দণ্ড দেন। ৮ ডিসেম্বর, ১৯৬৮ সালের শীতের রাতে মকবুল বাট তার দুই সঙ্গীসহ শ্রীনগর কারাগারের ৩৮ ফুট দীর্ঘ সুড়ঙ্গ তৈরি করে পলায়ন করেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ে ভ্রমণ করার কারণে তাদের সবার পা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। তারা অনেক কষ্ট করে অধিকৃত কাশ্মির ও আজাদ কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ রেখা পর্যন্ত পৌঁছেন এবং স্থানীয় লোকদের নিজেদের পরিচয় দেন। জনগণ তাদের কাঁধে উঠিয়ে গ্রামে নিয়ে এসে ক্ষতবিক্ষত পায়ের চিকিৎসা করেন। মকবুল বাট নিজে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে খবর দেন। তাকে চিনারি নিয়ে যাওয়া হয়। সেনাবাহিনীর জওয়ানরাও তার বেশ সেবা করেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান যখন জানতে পারেন, এ সেই মকবুল বাট, যে কে এইচ খুরশিদের সঙ্গী, তখন তিনি শ্রীনগর কারাগার থেকে পালানো ওই তিন ব্যক্তিকে মুজাফফরাবাদের ব্ল্যাক ফোর্টে বন্দী করার নির্দেশ প্রদান করেন।

জেনারেল আইয়ুব খানের নির্দেশে মকবুল বাটের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়, এ বিষয়ে তিনি খুব কম মুখ খুলেছেন। বলতেন, অপরের নির্যাতনে চিৎকার করতে পারি, কিন্তু আপনদের নির্যাতনে কী বলব? আইয়ুব খানের ধারণা ছিল, মকবুল বাট তাসখন্দ চুক্তির বিরুদ্ধে একটি আতঙ্কের নাম। সুতরাং তাকে বন্দী করে রাখা হোক। তবে তার গ্রেফতারির বিরুদ্ধে আজাদ কাশ্মিরসহ পাকিস্তানের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায় এবং কিছুদিন পর তাকে মুক্তি দেয়া হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে এলে মকবুল আজাদ কাশ্মিরের পাশাপাশি গিলগিট-বালটিস্তানেও নির্বাচনের দাবি করেন। তিনি যখনই সেখানকার অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হতেন, তখনই তাকে গিলগিটে গ্রেফতার করা হতো।

৩০ জানুয়ারি, ১৯৭১ সালে দুইজন কাশ্মিরি যুবক হাশেম কুরাইশি ও আশরাফ কুরাইশি ইন্ডিয়া এয়ারলাইন্সের ‘গঙ্গা’ বিমান হাইজ্যাক করে লাহোরে নিয়ে যান। ওই অভিযোগে আবার মকবুল বাটকে গ্রেফতার করা হয়। দুই বছর পর তিনি মুক্তি পেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো এক সাক্ষাৎকারে তাকে প্রস্তাব দেন, আপনি পিপলস পার্টিতে যোগ দিলে আজাদ কাশ্মিরের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন। মকবুল তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আমার গন্তব্য প্রধানমন্ত্রী হওয়া নয়, বরং কাশ্মিরের স্বাধীনতা। ১৯৭৬ সালে তিনি অধিকৃত কাশ্মিরে ফিরে যান এবং দ্বিতীয়বার গ্রেফতার হন।

জেনারেল জিয়াউল হকের যুগ এলে তার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আগা শাহী তাকে কাশ্মিরে স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্যের পরামর্শ দিতেন, কিন্তু জেনারেল জিয়া এ পরামর্শ উড়িয়ে দিতেন। কেননা তিনি আমেরিকাকে সাথে নিয়ে আফগানিস্তানে ব্যস্ত ছিলেন। ওই সময়, ১৯৮৪ সালে ভারত সিয়াচেনের পর্বতমালা দখল করে নেয়। তখন জেনারেল জিয়ার চোখ খুলে যায়। ওই বছর ১১ ফেব্রুয়ারি মকবুল বাটকে ফাঁসি দেয়া হলে কাশ্মিরে বিক্ষোভ শুরু হয়। এরপর পাকিস্তানের পলিসিতে পরিবর্তন আসে এবং কাশ্মিরিদের প্রকাশ্যে সহযোগিতা করা হয়।

১৯৭৩ সালে মকবুল বাট লাহোরের ক্যাম্প জেলে বন্দী ছিলেন। জেলখানা থেকে তার সঙ্গী জি এম মীরের কন্যা আজরা মীরের এক পত্রের জবাব দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, তাকে পাকিস্তান নয়, গাদ্দার শাসকপক্ষ কারাগারে বন্দী করেছে। তিনি লিখেছেন, পাকিস্তানের জনগণ আমাদের খাঁটি বন্ধু ও সমর্থক। যখনই কাশ্মিরিরা এগিয়ে যাবে, তখনই ওরা তাদের পাশে থাকবে। এ পত্র মকবুল বাটের পত্রাবলি নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থ ‘শুউরে ফারদা’র অন্তর্ভুক্ত। নওয়াজ শরিফ সরকার ২১ আগস্ট, ১৯৯৮ সালে ওই গ্রন্থের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তবে পাকিস্তানের জনগণের অন্তর থেকে তার প্রতি ভালোবাসাকে বের করে দেয়া যায়নি। শ্রীনগরে মাজারের মধ্যে মকবুল বাটের পাশাপাশি আফজাল গুরুর কবরও শূন্য পড়ে রয়েছে, যাকে ২০১৩ সালে তিহার কারাগারে ফাঁসি দিয়ে ওখানেই দাফন করা হয়। এ শূন্য কবরগুলো যেন ডাকাডাকি নয়, বরং হুঙ্কার দিচ্ছে এবং দুনিয়াকে বলছে, কাশ্মিরিরা তাদের স্বাধীনতা নিয়ে কোনো সমঝোতা করবে না। মৃত্যুকে স্বাগত, গোলামিকে নয়।
পাকিস্তানের জাতীয় পত্রিকা দৈনিক জং ১১ ফেব্র“য়ারি, সংখ্যা থেকে ভাষান্তর
ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
[email protected]
লেখক : পাকিস্তানের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট, প্রেসিডেন্ট জি নিউজ নেটওয়ার্ক (জিএনএন)















You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.