Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

লন্ডনের হিথরো যখন সিলেট বিমানবন্দর







শাকুর মজিদঃ লন্ডনের আকাশসীমায় আমাদের বিমানটি আসা মাত্র আমার দুই পুত্র রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। একজন হাতে নিয়েছে আইপ্যাড, আরেকজন ডিএসআরএল ক্যামেরা। তারা বিমানের ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে লন্ডন দেখার জন্য উদগ্রীব হয়েছে। সামনের ডিসপ্লের হিসেব মতে, আর ৮ মিনিট পর বিমান নামবে হিথরো বিমানবন্দরে।



এমন সময় ক্যাপ্টেনের বানী, ‘বিমানবন্দরের রানওয়েতে পার্কিং লটে জায়গা নাই। আর কিছু বিমান উড়ে না গেলে এটা নামতে পারবে না। সুতরাং আর ১৫ মিনিট এটা ঘরাঘুরি করে পরে নামবে।’

ইবন বলে, ‘বাবা এটা কিন্তু অয়ান অফ দ্য বিজিয়েস্ট এয়ারপোর্ট ইন দ্য অয়ার্ল্ড। তুমি জানো এখানে মিনিটে ৫টা বিমান ওঠানামা করে।’ জানি, প্রায় নব্বই বছর আগে হিথরো নামের এক গরুর খামারকে যখন বিমানবন্দর করা হয়েছিল তখন কে ভেবেছিল এমনটি হবে, অথচ এখন পুরো ইউরোপের প্রধান হবে!



১৫ মিনিট পরে ঠিকই নেমে গেল বিমানটি। আমি জানি এরপর অনেক দুর্দশা আছে আমার সঙ্গীদের। এই বিমান বন্দরটিতে মাইলখানেক না হেঁটে ইমিগ্রেশনের নাগাল পাওয়া যায় না। যখন নাগাল পেলাম দেখি জায়গাটা ঠিকই আছে, কিন্তু কালাকানুন বদলেছে অনেক। বিলেতি এই ইমিগ্রেশন কাউন্টারের প্রতি আমার একটু আলাদা দরদ। ১৫ বছর আগে কোনো ভিসা ছাড়াই তারা আমাকে ঢুকতে দিয়েছিল। আমেরিকা থেকে ফেরার পথে ৪ ঘণ্টা সময় ছিল হাতে। আমার এক বন্ধু (শুয়েব আহমেদ শওকতি) ট্রানজিট লাউঞ্জে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, কিন্তু তাকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। বিমানবন্দর পুলিশকে জানালে আমাকে বলা হলো, ট্রানজিট ভিসা নিয়ে যেতে হবে বাইরে, সেখানেই দেখা হবে।



আমি ইমিগ্রেশন অফিসারকে বলি, ‘আমার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করবো, সে বাইরে আছে, ১৮ বছর তাকে দেখিনি।’

১ মিনিটের মধ্যে একপাতার একটা ছোট্ট ভিসাফর্ম ফিলাপ করে দিলে আমার ভিসা হয়ে যায়। আমি বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে আমার ফ্লাইট পেছাই ১৪ ঘণ্টা এবং তখন থেকেই শুরু হয় রানীর দেশে আমার আগমন।

সেই ইমিগ্রেশন লাউঞ্জেই দেখি এখন অনেকটুকু বদলে গেছে। অবয়ব ঠিক, আচরণটা আলাদা। আমি যতই বলি না কেন যে এক গাঙ্গে দু’বার স্নান করতে চাই না, আসলে কি তা হয়? আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক দার্শনিক ও পর্যটক হেরাক্লিটাস বলেছিলেন, ‘No man ever steps in the same river twice, for it’s not the same river and he’s not the same man.’



৪৫ মিনিট কচ্ছপের মতো হামাগুড়ি দিয়ে আবার সেই ইমিগ্রেশন কাউন্টারে গিয়ে দাঁড়াই। সর্বশেষ দাঁড়িয়েছিলাম ৬ বছর আগে। সেখানে দুইটা প্রশ্ন ছিল—কেন যেতে চাও ইংল্যান্ড, আর কতদিন থাকবে। এর জবাব পাওয়ার পর ঠাস করে সিল মেরে মিষ্টি হেসে বলেছিলেন, ‘এঞ্জয় ইউওর ট্রিপ ইন লন্ডন।’ এবার দাঁড়ালাম ৪ জন একসাথে। সেই পুরোনো প্রশ্ন, কিন্তু যাচাই-বাছাই করতে সময় যাচ্ছে অনেক।

নতুন সংযোজন হলো আঙুলের ছাপ নেওয়া। আমাদের কাউন্টারের পেছনেই ফিতা দিয়ে বেড়া দেওয়া একটা কাউন্টার। অনেক লোক বসে আছেন সেখানে। একবার তাকিয়ে দেখি তারা সবাই ভিন্ন চেহারার। ভারতীয় চেহারার কেউ নেই। সবাইকে সন্দেহ করা হয়েছে তাদের ভিসা নিয়ে। এদেরকে আলাদা আলাদা করে ডাকা হবে। কেউ ইমিগ্রেশনের পাস পাবে, কেউ যাবে ফেরত। ইবন একবার আমাকে বলেছে, ‘বাবা পাজামা-পাঞ্জাবী পরা কোনো লোক দেখি না, তোমাকে কি পাস দেবে?’



আমি বলি, ‘কেন দেবে না? ওই দেখ, হাফপ্যান্ট পরা লোক আছে। হাফপ্যান্ট থাকলে পাজামা দেবে না কেন?’ আমি ছোটবেলা দেখেছি, আমাদের গ্রামে বহু লোক জীবনে প্রথম প্যান্ট পরেছিল হয় ঢাকায় ব্রিটিশ হাই কমিশনের ইন্টারভিউয়ের দিন, দ্বিতীয়বার পরতেন লন্ডনের বিমানে চড়তে। এই নিয়ে একটা মজার ঘটনাও শুনেছিলাম।

এক লোক লন্ডনে যাওয়ার জন্য জীবনে প্রথম প্যান্ট বানিয়েছে। ফ্লাইটের দিন গ্রামের খলিফা (দর্জি) এসে নিজে এটা পরিয়ে দিয়েছে। প্লেনে উঠে প্রস্রাব করার প্রয়োজন হলে তিনি বিপদে পড়ে যান। ঘটনার কূল-কিনারা করতে না পেরে সাহায্য নেয় এয়ার হোস্টেসের। বিপদমুক্ত হয়ে তিনি ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে হোস্টেসকে বলেন, ‘মাইগো, খলিফা বেটায় তালা মারি থইয়া চাবি তুমার আতো দিয়া রাখসিল, বুঝছি।’

আমি পাজামা পরে এসেছি আরেক কারণে। এর আগে দুবাই এয়ারপোর্টের ট্রান্সফার চেক-ইন-এর সময় জুতা-মোজা, বেল্ট পর্যন্ত খুলে তিনবার আসা-যাওয়া করায়। শুধু তা নয়, আরব দেশি সাব-ইন্সপেক্টর যে কর্কশ ভাষায় জ্যাকেট খুলতে বলে তা শুনতে ইচ্ছে হয় না। পাজামা-পাঞ্জাবীতে এই ভয় নেই, কাতারের দোহার বিমানবন্দরের ট্রানজিট চেক-ইনে আমাকে পারলে সালাম দেয়, কিন্তু এখানে কিছু হবে কি!

রোমে যখন যাবে, রোমানের মতো আচরণ করবে- এমন কথা শুনে এসেছি অনেক। কিন্তু ইংরেজরা যখন ভারতে গিয়েছিল তারা ভারতীদের মতো আচরণ করেনি, তারা তাদের মতো করেছিল। সেসব দেখে কিছু ভারতীয় ভারতে থেকেও ব্রিটিশদের মতো করে পোশাক পরা শুরু করেছিল। সেখান থেকেই আমরা শিখেছি কোট-প্যান্ট-স্যুট-টাই এবং আভিজাত্য প্রকাশের জন্যই আমরা এই বেশটি ধারণ করে থাকি। একবার দেখি না কী হয়, যখন আমি তাদের দেশে নিজের পোশাক পরে ঘুরে বেড়াই!

নির্বিঘ্নে ইমিগ্রেশন-কাস্টম পার হয়ে বিমানবন্দরের বাইরে এসেই দেখি হিথরো বিমান বন্দরে আরেকখানি সিলেট বিমানবন্দর হয়ে গেছে। শত শত যাত্রী একের পর এক বেরোচ্ছে। নিজের মতো করে বেরিয়ে কেউ পার্কিং লটে, কেউ বাইরের ট্যাক্সি বা বাস-ট্রেন স্টেশনের দিকে চলে যান। আমাদের জন্য দাঁড়ানো একদল বাংলাদেশি এবং এরা সবাই আমার নানা বাড়ির লোক। তাদের মধ্যে মহা-উত্সবের ভাব।

আমার নানা যখন তার সন্তানদের লন্ডন নিয়ে আসার চেষ্টা শুরু করেন তখন তার কিশোরী কন্যা কুসুম খালাকে দেশে রেখে আসার চিন্তা করেছিলেন। বিলেতের পরিবেশ মেয়েদের জন্য নাকি সুবিধার ছিল না। কিন্তু তখন তার বয়স ১২-১৩, তাকে কোথায় কার কাছে রেখে আসা হবে এই নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান। ঠিক হলো তাকে নিয়ে যাওয়া এন্ট্রি ভিসার জন্য। ভিসা পেয়ে গেলে কিছুদিনের জন্য নেওয়া হবে লন্ডনে। পরে দেশে এনে বিয়ে দেওয়া হবে। লন্ডনে যাবে আমার মামারা রুজি-রোজগার করার জন্য। কিন্তু ঘটনা সে রকম কিছু ঘটলো না, ঘটেছে অন্যটি। এখন কুসুম খালা হচ্ছেন আমার লন্ডনের নানা বাড়ির সবচেয়ে বড়ো মুরুব্বি। তার স্বামী শাহাব উদ্দিন বেলাল খ্যাতনামা সমাজকর্মী, প্রাক্তন কাউন্সিলর, সাংবাদিক। আমার বাকি সব মামা-খালা-খালুর চেয়ে বয়সে বড় এবং এই পরিবারকে মোটামুটি নেতৃত্ব দেন এই যুগল এবং তাদের ব্যবস্থাপনায় আমার দুই মামা, তিন খালা, মামা-খালাতো এবং নিজের দুই ভাইসহ ১৪ জনের এক বহর নিয়ে এসেছেন লন্ডনের বিমানবন্দরে, যেমন লন্ডন প্রবাসীদের গ্রহণ করার জন্য লেইটেস গাড়ি রিজার্ভ করে সিলেটের বিমানবন্দরে যায়, অনেকটা সে রকমই এবং লক্ষ্য করি যে, আমার তিন খালা মেচিং করে একই রকমের তিনটা শাড়ি পরে এসেছেন। ৪০ বছর ধরে লন্ডনে বসবাস করেও বিলেতী পোশাকে তারা অভ্যস্ত হতে পারেননি। লন্ডনে থেকেই আছেন সিলেটের মতো করে। মিনিট পাঁচেকের মতো সময় এই পুরো লাউঞ্জটা একখণ্ড সিলেটে পরিণত হয়ে যায়। আমাদের সবার মোবাইল ক্যামেরা সেলফির জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমাদের উত্সাহ দেখে এক খাস লন্ডনী তার বহির্গমন থামিয়ে আমাদের কাছে এসে দাঁড়ান, খানিক থামেন।

মনে হলো কিছু বলতে চান তিনি। লোকটির বয়স ষাটের কাছাকাছি, তিনি লন্ডনেই থাকেন, বার্লিন গিয়েছিলেন, আজ ফেরত এলেন। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘এরা সবাই তোমাকে নিতে এসেছে! বাহ, তুমি তো অনেক ভাগ্যবান। তোমরা সবাই দাঁড়াও, আমি একটা ছবি তুলি তোমাদের।’

তিনি প্রথমে তার ক্যামেরায় আমাদের ছবি তুললেন। এরপর একে একে সবার ফোন-ক্যামেরা তার কাছে গেল, তিনি পরম আনন্দের সঙ্গে সবগুলো ক্যামেরায় ছবি তুলে বিদায় নিলেন। হিথরো বিমানবন্দর কদাচিত্ এমন সিলেটের বিমানবন্দরে পরিণত হয়ে যায়।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.