Beanibazarview24.com
তাফাজ্জুল তপু, ইতালীঃ মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তনটা আসে নিজের ভেতর থেকে, অন্য কারো জোর করা বা চাপিয়ে দেয়া থেকে নয়। নিজের জন্য দরকারি পরিবর্তন নিজে থেকেই আসে। কয়েকদিন আগে এলাকা পরিচিত এক মামার বিয়ে থেকে আসলাম। তিনি একজন ইতালীয়ান ক্যাথলিক মেয়েকে মুসলমান করে বিয়ে করেছেন। পশ্চিমা বিশ্বে হলেও একজন ক্যাথলিক মেয়েকে মুসলমান করে তার নাম জোভান্না থেকে খাদিজাতে পরিবর্তন করে কনের পরিবারের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বিয়ের আয়োজন করাটা কিন্তু চাট্টিখানি কথা নয়।
সব দেশের মানুষেরই তো নিজ নিজ একটি রীতি-রেওয়াজ আছে। কিন্তু এ বিয়ে যেন ছিল দুই আলাদা সংস্কৃতির মানুষের মিলন মেলা। বাংলাদেশে যেখানে হঠাৎ করে একটি বিয়ের আয়োজন করা যায়, ইতালীয়ানরা বিয়ের দিন ঠিক করে অনেক আগে থেকেই। তারপর শুরু হয় বিয়ের আয়োজন। যেমন- নব দম্পতিরা তাদের পছন্দমত একটি ঘর দেখেন, বিয়ের অনুষ্ঠানে কি কি খাবার পরিবেশন করা হবে তা নির্ধারণ করা, হানিমুনের পরিকল্পনা, বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য একটি হল ভাড়া করা ইত্যাদি।
আমাদের দেশে যেভাবে বিয়েতে ঢালাওভাবে আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত করা হয়, এখানে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে দু-পরিবারের একান্ত আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধব ছাড়া অপরিচিত কাউকে নিমন্তণ করা হয় না। যাদের নিমন্ত্রণ করা হবে, তারা আবার বিয়ের কয়েক মাস আগেই বিয়েতে উপস্থিত থাকবেন কি না, তা নিশ্চিত করতে হবে। যারা যারা উপস্থিত থাকবেন তাদের নাম এবং তাদের পরিবারের সদস্য অনুযায়ী খাবারের টেবিল সাজানো হবে। তাই এখানকার বিয়েতে আমন্তিত অতিথিদের সংখ্যা খুব একটা হয় না। বিয়ের দিন বর কনেকে অনেক ব্যস্ততম একটি দিন কাটাতে হয়।
কারণ, সকালে পূর্ব-নির্ধারিত গীর্জায় গিয়ে ধর্মীয়ভাবে বিয়ে সম্পন্ন করতে হয়। তারপর এই বিয়েকে স্বরণীয় করে রাখার জন্য বর কনে বেরিয়ে পরে বিয়ের ছবি ভিডিও করার জন্য সুন্দর, মনোরম কোন স্থানের উদ্দেশ্যে। তারপর সন্ধ্যায় বিয়ের অনুষ্ঠানের হলে আসেন। তাদের হলে প্রবেশের সাথে সাথে করতালির মাধ্যমে উপস্থিত অতিথিরা স্বাগতম জানান। তারপর শুরু হয় খাওয়া দাওয়ার পর্ব।
বাংলাদেশের বিয়েতে আমন্তিত অতিথিদের সংখ্যা বেশি থাকায়, একসাথে সবার খাবার পরিবেশন করা সম্ভব হয় না। কিন্তু এখানে এক সাথে সবার খাবার পরিবেশন করা হয়। এ দেশে বিয়ের খাবার পরিবেশনা আমাদের দেশের প্রচলিত বিয়ের খাবার পরিবেশনা থেকে সম্পূর্র্ণ আলাদা। এখানে অতিথিদের প্রথমে ব্যুফে পরিবেশন করা হয়- তারপর মেইন ডিস, তারপর সেকেন্ড ডিস। তারপর বর-কনের সাথে অতিথিরা নাচে অংশগ্রন করেন।
এরপর বর-কনে বিয়ের কেক কাটেন। তারপর আবার সবার জন্য মিষ্টি, কেক, ফলমূলের ব্যুফে পরিবেশনের মাধ্যমে বিয়ের দিনের অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটে। তবে বিয়ের শুরু থেকেই সবার জন্য শ্যাম্পেন ও অন্যান্য পানীয়ের ব্যবস্থা থাকে।
তবে আমি যে বিয়ের কথা বলছি তা তো অনেকটাই আলাদা। সকালে এক মসজিদের ঈমাম তাদের বিয়ে পড়ান। তারপর বর-কনে পৌরসভায় গিয়ে তাদের বিয়ে সম্পূর্ণ করেন। বরের ইতালীয় পরিবারের কেউ না থাকায়, বরের পক্ষের আমরা হাতে গোনা ১০-১৫ জন ছিলাম।
তারপরও আমাদের জন্য আলাদা কোন হালাল খাবারের ব্যবস্থা না করে বিয়ের সম্পূর্ণ খাবার-দাবার হালাল পরিবেশন করা হয়। তবে ব্যুফে পরিবেশনে মেক্সিকান, আরাবিয়ান, সিসিলিয়ান হরেক রকম খাবারে সাথে ছিল সমুচা, কাবাব, বিরিয়ানী, পিয়াজুসহ নানান রকম বাংলাদেশী খাবারের আইটেম।
অনুষ্ঠানের প্রায় পুরো অংশেই ডিজে হিন্দি গান বাজাচ্ছিল, বিয়ে বাড়ি থেকে শুরু করে বাসর ঘর সাজানো পর্যন্ত সব কিছুতেই ছিল দেশীয় স্পর্শ। এগুলো সব কনের পক্ষের আত্মীয়রা ইন্টারনেটে দেখে দেখে সাজিয়েছিল। ইতালীয়ান অতিথিদের মধ্যে তাদের প্রচলিত বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে কিছুটা ব্যতিক্রম এই আয়োজন নিয়ে ছিলো না কোন আলোচনা সমালোচনা কিংবা কোন বিরক্তির লেশ। বরং এই বিয়ে নিয়ে তাদের আকর্ষণ বা উৎসাহ ছিল লক্ষ্য করার মত। এই আয়োজনে ছিলো না কোন বৈষম্য-ভেদাভেদ। আর এটি সম্ভব হয়েছে একমাত্র তাদের অন্য সংস্কৃতির প্রতি সম্মান ও আন্তরিকতা থেকে।
অন্য সংস্কৃতির কিংবা ধর্মের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মানে এই নয় যে, নিজের ধর্ম বা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করা বা হেয় করা। তবে হ্যাঁ, তা করতে জানতে হয়। কাছাকাছি সময়ে বাঙালীর ঘরে আসে দুই আনন্দ। মুসলিম বাঙালিদের ঈদুল আযহায় ত্যাগের মহিমা উদযাপনের ব্যস্ততা শেষ হতে না হতেই, রঙ-তুলির আঁচরে প্রতিমাকে রাঙিয়ে তুলতে খাওয়া-দাওয়া ভুলে যায় হিন্দু বাঙালিরা।
এই না হলে উৎসব! এই উৎসবকে কেন্দ্র করে যেন আমাদের মাঝে কোন বৈষম্য-ভেদাভেদের সৃষ্টি না হয়। আর এ জন্য একে অন্যের প্রতি সম্মান, ভালোবাসা আর আন্তরিকতাই যথেষ্ট। ঈদুল আজহা স্বার্থপর ভোগের বদলে ত্যাগ-আর মিলনের আনন্দই মুখ্য করে তোলে। ব্যতিক্রম হয় না শারদীয় উৎসবেও। এসব উৎসব বাঙালির, এই মিলন মানুষে মানুষে।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.