Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

৫০০০ কারিগর দীর্ঘ ১২ বছর ধরে নির্মাণ করে দিল্লির জামে মসজিদ


মুঘল আমলে নির্মিত হয় দিল্লি জামে মসজিদ। অন্যন্য স্থাপত্যশৈলীর এই মসজিদটি সবাইকেই আকৃষ্ট করে। জানেন কি? এই মসজিদটির দীর্ঘ এক ইতিহাস রয়েছে। ভারতবর্ষের বুকে মুঘল সূর্যাস্ত ঘটেছে সেই কয়েকশত বছর পূর্বেই। পৃথিবীখ্যাত সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, আকবরদের বিশাল সাম্রাজ্য কালের বিবর্তনে বিলীন হয়ে গেছে।

তবে আজো মুঘলদের ছাপ ভারতবর্ষ থেকে একেবারে হারিয়ে যায়নি। অধুনা ভারতের প্রতিটি প্রদেশে মুঘলদের কীর্তি যুগ যুগ ধরে টিকে আছে। ভারতের রাজধানী শহর দিল্লির কথাই ধরা যাক। বিখ্যাত লাল কেল্লা, দিল্লি জামে মসজিদ, জাফর মহল, হুমায়ুনের সমাধিক্ষেত্র, খান-ই-খানার সমাধি, ফতেহপুর মসজিদসহ শত শত স্থাপনাশৈলী হারানো মোঘল সাম্রাজ্যকে গৌরবের সঙ্গে প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। ইতিহাস এবং অসাধারণ স্থাপত্যশৈলীর বদৌলতে এসব স্থাপনা সারাবিশ্বের পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।

দিল্লিতে নির্মিত এসব স্থাপনার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার নাম নিলে প্রথমেই আসবে দিল্লি জামে মসজিদের নাম। ‘প্রিন্স অব বিল্ডার্স’ নামে পরিচিত সম্রাট শাহজাহানের আমলে নির্মিত এই মসজিদটি। এটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, পুরো পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ।

ভারতের রাজধানী দিল্লির পুরাতন দিল্লি অংশে অবস্থিত ‘মসজিদ-ই-জাহান নুমা’, যা দিল্লি জামে মসজিদ নামে সমধিক পরিচিত। মসজিদ-ই-জাহান নুমা শব্দটির অর্থ ‘বিশ্বের প্রতিফলন ঘটে যে মসজিদে’। ১৭শ শতাব্দীতে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে নির্মিত হয় এই মসজিদটি। দিল্লি জামে মসজিদ যুগ যুগ ধরে ভারতীয় মুসলিমদের আদর্শের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

ধর্মীয় গুরুত্বের বাইরেও এটি দিল্লি পর্যটনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। আপনি দিল্লি বেড়াতে যাবেন অথচ জামে মসজিদ দেখে আসবেন না, তা হয় না। ঘনবসতিপূর্ণ দিল্লির বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটির অবস্থান চাঁদনি চকের পাশে অবস্থিত লাল কেল্লার বিপরীতে। জেনে রাখা ভালো, ভারতীয় সার্বভৌমত্বের প্রতীক এই লাল কেল্লাও সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশেই নির্মিত হয়েছে। দিল্লি জামে মসজিদের স্থাপত্যশৈলীর অনুকরণেই সম্রাট আওরঙ্গজেবের নির্দেশে পাকিস্তানের লাহোরে অবস্থিত বাদশাহি মসজিদ নির্মিত হয়েছে।

মসজিদ নির্মাণের ইতিহাস

মুঘল আমলের শাহজাহানাবাদ (বর্তমান পুরাতন দিল্লি) শহরে সম্রাট শাহজাহানের নির্দেশে ১৬৪৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয় দিল্লি জামে মসজিদের। প্রায় ৫০০০ কারিগরের সহায়তায় দিনরাত পরিশ্রমের পর নির্মিত হয় এই মসজিদ। জেনে অবাক হবেন, এই মসজিদ নির্মাণ করতে লেগেছিল দীর্ঘ ১২ বছর। ১৬৫৬ সালে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ সমাপ্ত সমাপ্ত হয়।

এই মসজিদের নির্মাণকাজ উদ্বোধন করেছিলেন স্বয়ং শাহজাহান। মসজিদের কাজ তদারকির দায়িত্বে ছিলেন শাহজাহানের প্রধানমন্ত্রী সাদুল্লাহ খান। মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে শ্রমিকদের মজুরি কম ছিল। তারপরেও এই মসজিদ নির্মাণ করতে সম্রাটকে খরচ করতে হয়েছিল বেশ বড় অঙ্কের অর্থ। বর্তমান ভারতের হিসাবে সেই অর্থ দাঁড়াবে প্রায় ১০ লাখ রুপি।

১৬৫৬ সালের ২৩ জুলাই। সেদিন ছিল পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিন। ঈদের নামাজ আদায়ের মাধ্যমে সেদিনই শুভ উদ্বোধন ঘটে এই ঐতিহাসিক মসজিদের। উদ্বোধন অনুষ্ঠানের জন্য সম্রাট শাহজাহান সুদূর উজবেকিস্তানের বুখারা নগরী থেকে একজন প্রসিদ্ধ ইমামকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। তখনকার সময় ইসলামী জ্ঞানচর্চার গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল বুখারা।

সেখানকার ইমাম আব্দুল গফুর শাহ বুখারী সম্রাটের নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে প্রায় ১৮০৭ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে দিল্লি এসে পৌঁছান। ইমাম আব্দুল গফুর দিল্লি জামে মসজিদের প্রথম ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মসজিদটির ইমাম হিসেবে আব্দুল গফুরের বংশধরগণ নিযুক্ত হতে থাকেন। মসজিদের বর্তমান ইমাম মাওলানা সৈয়দ আহমেদ বুখারীও তারই বংশধর।

মুঘল আমলে নির্মিত হাজারো স্থাপনার মধ্যে দিল্লির জামে মসজিদ অনন্য। সম্রাট শাহজাহানের বাসভবন লাল কেল্লার মতোই এই মসজিদ নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল লাল বেলে পাথর এবং সাদা মার্বেল। মসজিদ এলাকার দৈর্ঘ্য প্রায় ২৬১ ফুট এবং প্রস্থ ৯০ ফুট। মসজিদে প্রবেশের জন্য নির্মিত হয়েছে তিনটি নান্দনিক প্রবেশদ্বার। প্রতিটি পথ দিয়ে প্রবেশের সময় আপনাকে পাড়ি দিতে হবে গড়ে ৩৫টি সিঁড়ি।

কারণ মসজিদটি ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উচ্চতায় নির্মিত হয়েছে। উঁচু ভূমিতে নির্মাণের কারণে অনেক দূর থেকে এই মসজিদের কাঠামো চোখে পড়ে। এছাড়া এই মসজিদে রয়েছে তিনটি মার্বেলের তৈরি গম্বুজ, ৪টি টাওয়ার এবং ২টি মিনার। মসজিদের বিস্তৃত নামাজের স্থানে একসাথে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে সক্ষম হয়। এটি ভারতের বুকে সবচেয়ে বড় জামাতের স্থান। মসজিদ চত্বরে মুসলিম নারীদের নামাজ পড়ার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে।

মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশদ্বারটিকে রাজকীয় দ্বার হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কারণ সম্রাট শাহজাহান এই দ্বার দিয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেন। মসজিদের ২টি মিনার ৫ তলা বিশিষ্ট এবং বেলকনিযুক্ত। মিনারগুলোর গড় উচ্চতা প্রায় ১৩০ ফুট। মিনারের সবচেয়ে উঁচুতে উঠতে হলে আপনাকে ১৩০টি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে। মিনারগুলোর উঁচুতে উঠলে আপনি পুরো দিল্লিকে এক নজরে উপভোগ করতে পারবেন।

এই মসজিদের মেঝেগুলো কালো এবং সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে নির্মিত। মসজিদের অভ্যন্তরের প্রাচীরে শোভা পাচ্ছে ক্যালিগ্রাফি, ফুলের নকশা, ফারসি শিলালিপি, ইসলামি ধাঁচের নকশা। মসজিদের ভেতর হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর স্মৃতিবিজড়িত দাঁড়ি মোবারকের একটি লাল চুল, মার্বেল পাথরের উপর পদচিহ্ন এবং হরিণের চামড়ার উপর লেখা পবিত্র কোরআন সংরক্ষিত রয়েছে।

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ সরকার জামে মসজিদ ক্রোক করে দেয়। এরপর সেখানে ব্রিটিশ সেনা মোতায়েন করা হয়। মুঘল আমলের বিভিন্ন কাঠামো ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ায় গত শতাব্দীতে মসজিদ মেরামত এবং সংস্কারের কাজ শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে হায়দ্রাবাদের নিজামের নিকট মসজিদের এক-চতুর্থাংশ সংস্কারের জন্য প্রায় ৭৫ হাজার রুপি অনুদান চাওয়া হয়। পরবর্তীতে নিজাম পুরো মসজিদ সংস্কারের জন্য তিন লাখ রুপি অর্থ সাহায্য দেন।

২০০৬ সালে দিল্লি জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে দুটি ভয়াবহ বোমা হামলা হয়। সেদিনের ঘটনায় ১৩ জন মুসল্লি আহত হন। তবে মসজিদের কাঠামোর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এরপর ২০১০ সালে ফের আক্রমণের শিকার হয় জামে মসজিদ। এই ঘটনায় দু’জন তাইওয়ানিজ নাগরিক আহত হয়। তবে এসব ঘটনার পরেও দিল্লি জামে মসজিদের গুরুত্ব কমেনি। ইতিহাসের পাতায় অনন্তকাল পর্যন্ত সম্রাট শাহজাহানের অনন্য সৃষ্টি হিসেবে এই মসজিদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এখনো পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ হিসেবে এই মসজিদ সমাদৃত হয়। বর্তমানে মসজিদটির তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দিল্লি ওয়াকফ বোর্ড দায়িত্বরত আছে। এর অনন্য ইতিহাস এবং স্থাপত্যকলা একে ধর্মমত নির্বিশেষে সবার নিকট গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.