Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

আজও আমি ওকে খুঁজে বেড়াই- ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রামে







সোশ্যাল মিডিয়া:
আমার প্রথম বিদেশ যাত্রা শুরু হয় ২০০৬ সালের ২৮শে মে রোববার ভোর ৫ টায়। ঢাকা থেকে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারের উদ্দেশ্যে প্রথম বিদেশ সফর শুরু হয়েছিল। সেজন্য ২৭ শে মে শনিবার দুপুরে সিলেট ওসমানী এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে আমাকে বাড়ি থেকে ইংল্যান্ডের পথে রওয়ানা দিতে হয়েছিল। সেদিন ছিল প্রচুর বৃষ্টি। সিলেটে গিয়ে সিলেট টু ঢাকার বিকাল ৩টার ডোমেস্টিক ফ্লাইটটি ধরার জন্য ওসমানী এয়ারপোর্টের ভিতরে পা রাখতেই ফর্সা, সুন্দর এক ভদ্রলোক এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই, আপনি কোন দেশে যাচ্ছেন?



আমি ইতস্তত করে লোকটির দিকে তাকিয়ে বললাম, ভাই, আমি ইংল্যান্ড যাচ্ছি।

ভদ্রলোক অতি নমনীয় ভাবে আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই, ফ্লাইটটি কি আগামীকাল ভোর ৫টার ফ্লাইট? কুয়েত এয়ারওয়েজে?

আমি বললাম, জ্বি হ্যাঁ। কিন্তু কেন?

ভদ্রলোক এবার জিজ্ঞাসা করলেন, তাহলে আপনি ম্যানচেস্টার যাচ্ছেন?

আমি এবার বিরক্তির সুরে বললাম, জ্বি ভাই, আমি ম্যানচেস্টার যাচ্ছি।

ভদ্রলোক নাছোড় বান্দা। এবার কাছে এসে মিনমিন কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ভাই আরেকটি কথা। ঢাকায় কোন হোটেলে উঠবেন?

আমি বললাম, সুন্দরবন হোটেলে।

ভদ্রলোকের সাথে কথা শেষ করে আমি বৃষ্টির পানিতে ভিজে যাওয়া আমার লাগেজটির দিকে বারবার চোখ ফেলছিলাম। ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ডে আমার মামা থাকেন। তাঁর জন্য লাগেজে বেশ কিছু আরবী কিতাব সঙ্গে নিয়েছিলাম। ভুলবশত বৃষ্টির পানিতে লাগেজটি লেপ্টে গিয়েছিল। লাগেজের ভিতরের কিতাবগুলোর অবস্থা কি হয়েছে ভেবে আমার মনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। যাক, আমি বোর্ডিং পাস সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কাউন্টারের দিকে এগোতে যাব ঠিক সেই মুহূর্তে ভদ্রলোকটি ২০/২২ বছরের একটি কিশোরী মেয়েকে সাথে নিয়ে আবার আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, ভাই, এই হলো আমার চাঁচাত্ব বোন তাসফিয়া। ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টারে ওর জন্ম-কর্ম ও বেড়ে ওঠা। দেশে ও বেড়াতে এসেছিল। এখন একা একা ইংল্যান্ড যাচ্ছে ভেবে একজন লোক খুঁজছিলাম যাতে ও একসঙ্গে যায়। ভাই আপনার সাথে ওর সমান ট্রানজিট। যদি মনে কিছু না নেন রাস্তায় আমার বোনটিকে একটু খেয়াল রাখবেন প্লিজ।

আমি সহজ সরল তাসফিয়ার দিকে একপলক তাকিয়ে হতাশ মনে ভাবলাম আগামীকাল ভোরে ঢাকার ইমাইগ্রেশনে গিয়ে আমারই বা কোন গতি হয় নিজেই জানি না। ঐ সময় ইংল্যান্ডের ইমাইগ্রেশনে খুব কড়াকড়ি চলছিল। নানা কেলেংকারির কারনে ইমাইগ্রেশন কর্তৃপক্ষ এয়ারপোর্টে যাত্রীদের উপর খুব খবরদারি করত। ইমাইগ্রেশন সেকশনে অনেক ভুয়া ভিসাধারিকে ছেড়ে দিয়ে আসল ভিসাওয়ালাকে ওরা আটকে রাখত।

মনে মনে হিসাব কষছিলাম- আগামীকাল ভোরে ঢাকার ইমাইগ্রেশন শেষ করে আমি কি ঠিকমত ম্যানচেস্টারের ফ্লাইটে উঠতে পারব? মনের কোনে হাজার প্রশ্ন উড়ে বেড়াচ্ছিল। এর বছর দুয়েক আগে ইংল্যান্ডগামী ভিজিটর ভিসাধারী আমার এক ছোট মামাকে ইমাইগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ঢাকা এয়ারপোর্টে আটকে রেখেছিল। তাকে ম্যানচেস্টারের ফ্লাইটে উঠতে দেয়নি। ওদের ওজুহাত ছিল কমবয়সি লোকেরা নাকি বাংলাদেশ থেকে ভিসা জাল করে ইংল্যান্ডের ফ্লাইটে উঠে যাচ্ছে। পরে আমি ঢাকায় গিয়ে বৃটিশ অ্যাম্বেসি থেকে একটি রিকগনেশন লেটার সংগ্রহ করে আমার ছোট মামাকে ইংল্যান্ডের প্লেইনে তুলে দিয়ে এসেছিলাম। ভদ্রলোকের কথায় উদাস মনে বললাম, ভাই আপনি ওকে নিয়ে চিন্তা করবেন না। আমি যতটুকু পারি আপনার কাজিনকে সাহায্য করব।

চারদিকে মোষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। আহা সে কি বৃষ্টি! এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ আমার এবং তাসফিয়ার বোর্ডিং পাস ইস্যু করলে আমরা ওয়েটিং রুমে গিয়ে জানতে পারলাম ঢাকামুখি ৩ টার ফ্লাইটটি খারাপ আবহাওয়ার কারণে নাকি যেতে বিলম্ব করবে।

আমার মনটি কিছুক্ষণে আরও খারাপ হয়ে গেল। প্রথমত দেশের চেনাজানা সবাইকে ছেড়ে বিদেশে রওয়ানা দিচ্ছি। দ্বিতীয়ত দেশে অতি অল্প বয়সে সরকারি-বেসরকারি সব মিলিয়ে দুতিনটি চাকুরি করেছি। দিনগুলো মোটামুটি ভালই চলে যাচ্ছিল। এছাড়া আমি ইংল্যান্ডের ভিসা পাবার কিছুদিন আগে বাংলাদেশ আর্মি অডিটরের ইন্সপেক্শন শাখায় ঢাকার সরকারী তিতুমীর কলেজে গিয়ে একটি চাকুরির জন্য দুদিন ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছিলাম। ইংল্যান্ড রওয়ানা দেবার আগের সপ্তাহে সেগুনবাগিচার প্রতিরক্ষা বিভাগ থেকে সেই ইন্টারভিউর একটি চিঠি এসেছে। আমাকে খুব তাড়াতাড়ি ঢাকায় গিয়ে ভাইভায় অংশগ্রহণের জন্য বলা হয়েছে। তখনকার সময়ে ঐ চাকুরিটির প্রাথমিক বেতন ছিল- ১৮,০০০/০০ টাকা।

এইসব চাকুরি-বাকুরি দূরে সরিয়ে ইংল্যান্ডের অনিশ্চিৎ জীবনের দিকে রওয়ানা দিচ্ছি ভেবে মনটা ব্যাকুল হয়ে যাচ্ছিল।

ওয়েটিং রুমে গিয়ে বিকাল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত একটানা এক ঘন্টা অপেক্ষার পর ফ্লাইটের কোন খবর নেই দেখে মনটা উতলা হয়ে উঠেছিল। আমি হতাশ মনে ওয়েটিংরুমের এদিক ওদিক পায়চারী করছিলাম। আমাদের সাথে ওয়েটিংরুমে ঢাকাগামী আরও ২০/২২ জন যাত্রী বসা ছিলেন। এদের কেউ বসে মাথা ঝিমুচ্ছিলেন আবার কেউ গলা ফাটিয়ে জিএমজি এয়ারলাইনসকে গালাগালি দিচ্ছিলেন।

দীর্ঘক্ষন পায়চারীর পর হঠাৎ আমি তাসফিয়ার দিকে লক্ষ্য করে বুঝতে পারলাম ও আমাকে কিছু বলতে চাচ্ছে। আমি ওর কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কি? তুমি আমাকে কিছু বলবে?

ও আমার দিকে তাকিয়ে একটু ইতস্তত করে আস্তে আস্তে বলল, ইকানো পানি আছে নি? আমি পানি খাইতাম।

আমার সাথে ওর এই প্রথম কথা বলা শুরু। এর আগে ওর লাগেজগুলো বেল্টে দিতে গিয়ে ওর সাথে আমার আকার ইঙ্গিতে দুয়েকটি কথা হয়েছে। আমি ওর দিকে চোখ স্থির না করে এয়ারপোর্টের স্ন্যাকবারের ক্যাফের দিকে ছুটলাম। মাম এর এক লিটারের একটি পানির বোতল ৬০ টাকা দিয়ে কিনে এনে আমি দ্রুত তাসফিয়ার হাতে দিয়ে বললাম, পানি খাও।

ও পানির বোতলটি হাতে নিয়ে চোখের পলকে মুখের ছিপি খোলে ঢকঢক করে কয়েক মিনিটে পুরো বোতলটি শেষ করে দিল। আমার জীবনে এই প্রথম কোন অপরিচিত মেয়ের প্রতি তাকিয়ে আমার মনটা কেমন যেন হয়ে গেল।

বিকাল ৫ টার দিকে আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ হতে সন্ধ্যা ৬টায় ঢাকায় গিয়ে ঢাকা এয়ারপোর্টের প্বার্শবর্তী সুন্দরবন হোটেলে ওঠলাম আমরা। তাসফিয়ার সঙ্গে থাকা দুটি লাগেজে ৬০ কেজি, আমার দুটি লাগেজে ৫৬ কেজি এবং দুজনের দুটি হ্যান্ডব্যাগে ১৫+১৫ আরো ৩০ কেজি সহ মোট ১৪৬ কেজি মাল হ্যান্ডটাকে তুলে ঠেলেঠুলে কোনভাবে এয়ারপোর্টের গাড়ীতে ওঠে আমি এবং তাসফিয়া যখন সুন্দরবন হোটেলে গিয়ে উপস্থিত হলাম তখন সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা। আমি পুরোপুরি টায়ার্ড। সুন্দরবন কর্তৃপক্ষ তাসফিয়াকে ৭ম তলায় এবং আমাকে ৫ম তলায় দুটি পৃথক রুম বুকিং দিতে তাসফিয়া তার প্রথম ইংলিশ ভাষা শুরু করল। আহারে কি সুন্দর ইংলিশ স্পিকিং। ম্যানেজার আর যায় কোথায়? শেষ পর্যন্ত ম্যানেজার বাধ্য হয়েই আমাকে এবং তাসফিয়াকে দুটি লাগোয়া রুম দিল।

বিকাল ৩টার দিকে সিলেট এয়ারপোর্টে যে মেয়েটির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ৪/৫ ঘন্টার ব্যবধানে ঢাকায় এসে এই মেয়েটির সাথে সেই মেয়েটির কোন মিল খোঁজে পাচ্ছিলাম না আমি। একটু কথাবার্তাতেই হোটেল ম্যানেজারকে কি ইংলিশ ধোলাই ই না দিল তাসফিয়া! ইংলিশের কি ফুলঝুড়িই না ছুটালো মেয়েটি!

হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল ভোর ২টায় এয়ারপোর্টের গাড়ি এসে আমাদেরকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। সুতরাং আমরা যেন এর আগে বেরুবার জন্য প্রস্তুত থাকি।

রাত ৯টার দিকে তাসফিয়া এবং আমি পাশাপাশি দুটি রুমে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম। হঠাৎ ও এসে আমার দরজায় কড়া নেড়ে বলল, বুক লাগছে। খাইলিতায় নি?

আমি তাসফিয়াকে নিয়ে খাবার রুমে গেলাম। ঢাকার একটি থ্রী স্টার হোটেলে বসে তাসফিয়ার সাথে জীবনে প্রথম আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও ভেজি সেন্ডউইচ খেলাম। আমি সেপারেট একটি বীফ বিরিয়ানীর অর্ডার করেছিলাম। আমি সেই বিরিয়ানিটা তাসফিয়ার সাথে শেয়ার করে ওর খাওয়ার ধরন দেখছিলাম। আসলে বৃটিশ বৃটিশই। দুনিয়ার যত জায়গায় যাবেন- দেখবেন বৃটিশরা সব কিছুতে এগিয়ে। ভদ্রতা, সৌজন্যতাবোধ, দয়া-মায়া, উদারতা, সাহায্য-সহযোগিতা সবকিছুতেই ওরা ইন্সট্রাক্টর। ওদের দেশে জন্ম নেওয়া মেয়েটির শরীরে বাঙ্গালীর রক্ত বইলে কি হবে? ও যে জাতে বৃটিশ। খাওয়া-দাওয়া শেষে তাসফিয়া একটি কোল্ড ড্রিংক এনে আমাকে কিছুটা দিয়ে বাকিটা সে নিজে শেষ করল। এরপর পাচ’শো টাকার একটি নোট টেবিলের উপর টিপ (বকশীশ) রেখে খাওয়ার রুম ছাড়ল।

রাত পোহাবার আগে আমি এবং তাসফিয়া ঢাকার ইমাইগ্রেশনে গিয়ে জীবনের বড় একটি অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। প্রথম ঝগড়াটি শুরু হল তাসফিয়ার লাগেজ নিয়ে এবং সেটা এয়ারপোর্টে ঢোকার মুল ফটকে।

তাসফিয়ার লাগেজগুলো স্ক্যানিং মিশিনে ঢোকিয়েই ওপারেটররা ঘোষনা দিল এই লাগেজে অবৈধ কাঁচা মাল আছে। লাগেজ দুটি খোলতে হবে।

আমার লাগেজগুলোতে তেমন কিছু ধরা পড়েনি। শুধু বইয়ের বান্ডিল দেখে ওরা কোন কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই আমি ডিক্লেয়ার করলাম এই লাগেজগুলোয় আমার লেখা কিছু উপন্যাস বই এবং আরবী কিছু কিতাব আছে। এইই।

ওরা জাতি ভাই ভেবে আমাকে ছেড়ে দিল। কিন্তু তাসফিয়ার বৃটিশ লাল পাসপোর্টটি দেখে ওরা মনেপ্রাণে ওর কাছ থেকে কিছু উদ্ধার করতে চাইল। গতরাতে যে মেয়েটি হোটেল বয়দের পাঁচ’শো টাকার একটি নোট টিপ দিয়ে এসেছিল সেই মেয়েটি কি না মাত্র এক হাজার টাকার জন্য পুরো একটি স্কেনিং ইউনিটের সাথে জামেলা শুরু করে দিল। ও ইংলিশে কি যে বলাবলি শুরু করল আমি সেটার ক-খও বুঝতে পারিনি। এখন হলে অবশ্য বুঝতাম। কারন দেশ-বিদেশে কাজকর্ম ও চলাফিরা করে এখন আমার ইংরেজি নলেজটা একটু পরিপক্ক হয়েছে। যাক, শেষ পর্যন্ত আমার পকেট থেকে পাঁচ’শো টাকার দুটি নোট ওদের হাতে গুজে দিয়ে আমি ওর লাগেজ দুটি নিয়ে কাস্টমসের দিকে এগোলাম।

সেখানে গিয়ে আবারও জামেলা। ওভারওয়েট। শেষ পর্যন্ত তাসফিয়া ৪ হাজার টাকা এবং আমি ২৭০০ টাকা ওভারওয়েট পেইড করলাম। কারন দুজনেই অতিরিক্ত মাল বোঝাই করেছি।
এরপর আমরা দুজন গিয়ে ইমাইগ্রেশনের লাইনে দাঁড়ালাম।

এতক্ষণ মালের কাস্টম হয়েছিল। এখন আমাদের কাস্টম শুরু। আমি তাসফিয়ার পিছনে দাঁড়িয়েছিলাম। ও হাত দিয়ে ঠেলে আমাকে ওর সামনে নিয়ে এল। আমি বললাম, কেন? তুমি সামনে থাকো।

ও বলল, আমি সামনে থাকলে আমাকে এবং তোমাকে দুজায়গায় দুটি সিট দিয়ে দেবে।

আমি মনে মনে আল্লাহ নাম জপছিলাম। জীবনের প্রথম বিদেশ মিশন। যদি অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটে যায়? যাক, ইমাইগ্রেশনে আমার ডাক পড়তেই দেখি তাসফিয়া আমার পিছু পিছু এসে অফিসারকে বলছে, দিস ইজ মাই রিলেটিভ। সো, উই ওয়ান্ট টু সীট ইন সেইম প্লেইস বিসাইডস উইন্ডো। ইজ ইট ওকে?

তাসফিয়ার কথায় ইমাইগ্রেশন অফিসারের মনে জোয়ার-ভাটা শুরু হয়ে গেল। ইমাইগ্রেশন অফিসার আমাকে অতিরিক্ত কিছু জিজ্ঞাসা না করেই আমার পাসপোর্টে শীল ছাপ্পড় মেরে তাসফিয়ার হাতে দুটি বোর্ডিং পাস ধরিয়ে দিয়ে বলল, ইয়েস মিস ওকে। বিনিময়ে তাসফিয়া অফিসারের দিকে মুচকি হেসে থ্যাংক্স বলে আমাকে নিয়ে ও আন্তর্জাতিক প্যাসেঞ্জারের লাউঞ্জে প্রবেশ করল।

ঢাকা থেকে কুয়েত আসতে ৬ ঘন্টা সময় লেগেছিল। এই সময়ে আমাদের মধ্যে ভাল একটি সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। কুয়েত এসে ৭ ঘন্টার বিরতি ছিল। তাসফিয়া আমাকে নিয়ে কুয়েতের পুরো এয়ারপোর্টটি ঘুরে বেড়াল। দুজনে ক্যাফেটরিয়ায় বসে হাল্কা খাবারও খেলাম। এরপর কুয়েত এয়ারওয়েজের ফ্লাইটটি কুয়েত থেকে যখন ম্যানচেস্টারের উদ্দেশ্যে আকাশে উড়াল দিল তখন তাসফিয়া পুরোপুরি ক্লান্ত। প্লেইন আকাশে উড়তেই তাসফিয়া তার দুটি চোখ আর খোলা রাখতে পারছিল না। সিলেট থেকে কুয়েত পর্যন্ত এসে ২০/২২ ঘন্টায় আমাদের মধ্যে খুব ভাল একটি আন্টারস্ট্যান্ডিং এবং জানাশোনা হয়ে গিয়েছিল। আমি ওকে বললাম- তাসফিয়া ডোন্ট ওরি। তুমি শোয়ে পড়ো।

ও আমার দিকে চোখ স্থির করে জিজ্ঞাসা করল- আর য়্যু সিওর? য়্যু ডো’ন্ট হ্যাভ এ্যানি প্রবলেম? তাসফিয়ার চোখ দুটি বুজে আসছিল।

আমি হাই তুলে মুখে হাতের আগল দিয়ে বললাম, অফকোর্স, আই ডো’ন্ট হ্যাভ এ্যানি প্রবলেম। তুমি শোয়ে পড়ো। আমি ওর দিকে আমার ডান কাঁধটা একটু বাঁকিয়ে দিলাম। এরপর তাসফিয়া প্লেইন ভর্তি মানুষের ভীড়ে তার মাথাটা আমার কাঁধে গুজে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।

আমি এবং তাসফিয়া কয়েক ঘন্টার পথচলায় অনেক কথাই বলাবলি করেছি। আমি একটি হাইস্কুলের মাস্টারি ছেড়ে ইংল্যান্ডে চলে যাচ্ছি শোনে ও দুয়েকবার মজা করে আমাকে বলেছে- স্যার, আপনে স্টুডেন্ট অকলরে পালাইয়া কিলাখান বিদেশ যাইরা? আপনার খারাপ লাগের না? আরেকবার বলেছে- স্যার, আপনে আমারে বাংলা মাত হিকাইবা নি? আরেকবার বলেছে- আপনার চেরায় আর মাতে আপনারে স্যামুয়েল জ্যাকসনের লাখান লাগে। আই লাভ স্যামুয়েল জ্যাকসন।

তাসফিয়ার এসব কথাবার্তা শোনে আমি কয়েক ঘন্টার পরিচয়ে ওর মধ্যে আমার নিজের প্রতিচ্ছবি খোঁজতে শুরু করেছিলাম। কুয়েত থেকে ম্যানচেস্টার যেতে ৯ঘন্টার জার্নিতে তাসফিয়া মাত্র দুবার চোখ খুলেছিল। একবার চোখ খোলে সে লাঞ্চ করেছে। আরেকবার চোখ খোলে সে বাথরুমে গিয়েছে এবং বাথরুম থেকে ফিরে ঢুলু ঢুলু চোখে আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে- আর কত সময় লাগব?

আমি প্লেইনের ভার্চুয়েল ম্যাপে চোখ স্থির করে বললাম- আমরা এখন জার্মানির উপরে আছি। আমার কথাটি তাসফিয়া পুরোপুরি শোনতে পেল কি না জানি না। ও মাথাটা আমার হাতের উপর রেখে আবার ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল। অবশেষে প্লেইনটি ইংল্যান্ডের আকাশ সীমায় প্রবেশ করতে আমি ওকে জাগালাম।

ও চোখ কচলে জিজ্ঞাসা করল- আমরা কি এসে গেছি?

বললাম, হ্যাঁ।

এরপর তাসফিয়া উঠে কিছুক্ষণে সব ক্লান্তি ঝেড়ে মুছে কয়েক মিনিটে পুর্নোদ্যমে বৃটিশ তরুনী সেজে গেল।

প্লেইন ল্যান্ড করতে হ্যান্ডব্যাগগুলো গুছগাছ করে আমরা যখন প্লেইন ছেড়ে বাইরে বেরুব তাসফিয়া তখন একটি পঞ্চাশ পাউন্ডের বৃটিশ লাল নোট আমার পকেটে গুজে দিয়ে বলল, আপনে ওউ টাকা রাখউকা। নয়া লন্ডন আইছইন। আপনার টাকা লাগব।

আমি তাসফিয়ার এই অযাচিত দান থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করেও বিফল হলাম। বললাম, আমি কিছু ব্রিটিশ টাকা সঙ্গে নিয়ে এসেছি।

তাসফিয়া আমার দিকে চোখ রাঙ্গিয়ে বলল, আমি যা বলেছি তা আপনাকে শোনতে হবে।

এরপর আমি বাধ্য ছেলের মত পঞ্চাশ পাউন্ডের নোটটি পকেটে ঢোকিয়ে মনে মনে ভাবলাম ইংল্যান্ডে যখন এসেছি ইনশাআল্লাহ সময় সুযোগে একদিন তাসফিয়ার এই ঋনটা আমি পরিশোধ করব।

ম্যানচেস্টার এয়ারপোর্টে ইমাইগ্রেশন শেষ করে বাইরে বেরিয়ে আমি তাসফিয়ার কাছে বিদায় নিতে গিয়ে যখন বললাম, ফোনে কথা হবে তাসফিয়া। তুমি ভাল থেকো।

আমার কথা শোনে তাসফিয়ার চোখ ছলছল করে ওঠল। ও হঠাৎ চোঁখের পলকে আমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। বলল, মামার বাসায় পৌঁছেই আমাকে ফোন দিও। আমাকে জড়িয়ে ধরে ও আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছিল।

কিছুক্ষণ পর আমাকে বিদায় দিতে গিয়ে ও নিস্তেজ কণ্ঠে বলল, জ্বি, ফোনে মাতমুনে। আফনে ভালা থাকইনজানো?

এরপর আমি আমার মামার গাড়িতে উঠতে গিয়ে দেখি তাসফিয়া দূরে দাঁড়িয়ে মলিন মুখে আমার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে হাত নাড়ছে।

আমার জীবনে দেখা শ্রেষ্ঠ একজন নারী তাসফিয়ার মলিন মুখ এবং ওর হাত নাড়ানো দেখে আমি চোখ ইশারায় ওকে বারবার বলার চেষ্টা করলাম- মামার বাসায় গিয়েই আমি তোমাকে ফোন দেব তাসফিয়া।

আমার জবাবে তাসফিয়াও হাত ইশারায় ফোনে কথা বলার ইঙ্গিত জানালো।

এরপর ব্রাডফোর্ডে মামার বাসায় গিয়ে আমি জীবনের সবচেয়ে বড় দুঃখটাই পেলাম। রাত ৮/৯ টার দিকে মামার বাসায় পৌঁছে আমি গভীর ঘুমে হারিয়ে গেলাম। পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠে একবুক আনন্দ, উৎসাহ নিয়ে আমি যখন মামার মোবাইল থেকে তাসফিয়াকে ফোন ঘুরালাম তখন আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। নাম্বারটি ডায়াল করতেই মোবাইল নেটওয়ার্কের সেল্ফ মোটিভেট আওয়াজ ভেসে এল- আনফরচুনেটলি উই ক্যান্নট কম্পলিট য়্যুর কল এজ ডায়েলড। প্লিজ চেক দ্যা নাম্বার এন্ড ট্রাই য়্যুর কল এগেইন।

আমার চিন্তাশক্তি একমুহূর্তে অকেজো হয়ে গেল। তাসফিয়ার সাথে কি করে যোগাযোগ করি সেই টেনশনে আমার শরীর থেকে ফোটা ফোটা ঘাম বেরুতে লাগল। আমি আবার নাম্বারটিতে চোখ বুলালাম। এরপর নাম্বারটি চেক করে দেখি একটি সংখ্যা কম। এজন্য ডায়াল নাম্বারটি অসম্পুর্ণ দেখাচ্ছে। এরপর লক্ষ্য করলাম ১৩ ডিজিটের নাম্বারের পরিবর্তে মাত্র ১২ টি ডিজিট লেখা আছে।

আমার চোখ থেকে কিছুক্ষণে ঝরঝর করে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তাসফিয়া প্লেইন থেকে বেরুবার আগে তাড়াহুড়া করে আমাকে নাম্বারটা লিখে দিয়ে বলেছিল, ইকটা আমরার ঘরোর নাম্বার। ফোন দিলে আমি ফোন ধরমু। কাইল সকালে ফোন দিও। আমি আপনার ফোনের অপেক্ষা করমু।

আমার জীবনে আর ওর জন্য কাইল সকাল হয়নি। একটি নাম্বারের ভুলের কারনে তাসফিয়া আমার জীবন থেকে সারা জীবনের জন্য দূরে চলে গেছে। তাড়াহুড়া করে ভুলবশত কোথায় একটি সংখ্যা কম লিখে দিয়েছিল তাসফিয়া। তাসফিয়ার হাতের লেখা এই ফোন নাম্বারটি নিয়ে আমি কত জায়গায় যে ঘুরে বেড়িয়েছি হিসেবে কুলোয় না। কিন্তু ওর সাথে আমার আর কোনদিন যোগাযোগের সুযোগ হয়ে ওঠেনি।

তাসফিয়াও সম্ভবত আমার ফোনের জন্য দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছে। এও হতে পারে সেও আমাকে পাগলের মত খোঁজে বেড়িয়েছে। ও হয়ত ভাবতে পারে ওর গিফ্ট করা টাকাটার জন্যে কমপক্ষে কৃতজ্ঞতা বোধ হিসাবে আমি ওর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করিনি কেন? কিন্তু ও তো কোনদিন জানতেই পারবে না যে ওর দেওয়া নাম্বারের ভুলের কারনে আমি ওকে বিভিন্ন জায়গায় খুঁজাখুঁজি করেও পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি।

তখনকার সময়ে ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসআপ অথবা ইমো ছিল না। নতুবা ওর সাথে যোগাযোগের একটা পথ খোঁজে বের করা যেত। আমি আজও ওকে খোঁজে বেড়াই বিভিন্ন সোশাল মিডিয়ায়। কয়েক ঘন্টা একসাথে পথচলার ফ্রেমে বন্দি হওয়া তাসফিয়া আজও আমার স্মৃতিপটে অমলিন হয়ে আছে। দোয়া করি ও যেখানেই থাকুক সর্বদা ভাল, সুস্থ, সুন্দর ও চিরসুখি থাকুক। শুধু এটুকুই বলব- আমি আজো ওকে খোঁজে বেড়াই- ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, হোয়াটসআপ এবং স্নাপচাটে। জানি ওর সাথে আমার আর কোনদিন দেখা হবে না। কিন্তু ওর স্মৃতিগুলো আজও আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায় এবং ওকে খোঁজে বেড়ানোর প্রেরনা যোগিয়ে যায়।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.