Beanibazarview24.com
ইউরোপে প্রবেশের অপেক্ষায় বলকান রুটে বসনিয়ার লিপা অভিবাসী ক্যাম্পে বাস করা এক বাংলাদেশি নিজের দুর্দশার কথা জানিয়ে বলেন, ‘দেশের ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো’।
বসনিয়া অ্যান্ড হ্যার্ৎসেগোভিনার ক্রোয়েশিয়ার সীমান্তবর্তী অঞ্চল উনা-সানা ক্যান্টনে নবনির্মিত ক্যাম্পে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা অভিবাসীদের একজন মোহাম্মদ মাইনুদ্দীন।
চার বছর আগে ২০১৮ সালে দেশ ছাড়েন মাইনুদ্দীন। দালালদের হাত ধরে ইউরোপে পৌঁছানোর উদ্দেশে বছরের পর বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ ঘুরে বসনিয়া পৌঁছান তিনি।
ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে থেকে যদি ম্যাসেজ নিতে চান, আমি মনে করি বাংলাদেশের ভিক্ষুকের জীবনও অনেক ভালো যারা বাই পথে আসে তাদের চেয়ে। আসলে বাস্তবতা অনেক কঠিন। আপনি পাহাড়ে চড়লেন। পুলিশের চেক আছে। পানি নেই। পাহাড়ে উঠতে অনেক কষ্ট হয়। খাবার থাকলেও পানির জন্য খাবার খেতে পারবেন না। তখন, কেমন লাগে? আসলে যারা বাস্তবতার সম্মুখীন হয় তারাই বলতে পারবে কষ্টটা কেমন।’
শুধু মাইনুদ্দীনই নন, গত কয়েক বছর ধরে হাজার হাজার বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ পাড়ি দিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে পৌঁছার চেষ্টা করছেন।
অভিবাসন বিষয়ে ইউরোপের সংবাদমাধ্যম ইনফোমাইগ্রেন্টস-এর তথ্যমতে, গত বছর অর্থাৎ ২০২১ সালের প্রথম ছয় মাসে অবৈধপথে ইউরোপে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের শীর্ষে রয়েছেন বাংলাদেশিরা।
পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশের অস্থায়ী ক্যাম্পে আটকে আছেন এমন অনেক বাংলাদেশি। সেখানকার সর্বশেষ পরিস্থিতি জানতে বসনিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্প পরিদর্শন করেছেন ডয়চে ভেলে বাংলার সাংবাদিক অনুপম দেব কানুনজ্ঞ ও আরাফাতুল ইসলাম।
জানা গেছে, বসনিয়ার লিপা ক্যাম্পে পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন দেশের প্রায় তিনশ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী রয়েছেন।
মাইনুদ্দীন জানান, লিপায় অবস্থিত এ ক্যাম্পটিতে বর্তমানে দশজন বাংলাদেশি আছেন। তাদের অনেকেই বসনিয়ার পার্শ্ববর্তী দেশ ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশ থেকে কীভাবে বসনিয়া পৌঁছালেন এমন প্রশ্নের জবাবে লিপা ক্যাম্পে থাকা আরেক বাংলাদেশি মোহাম্মদ সালাউদ্দীন বলেন, ইতালি যাওয়ার ইচ্ছা তার। সে ইচ্ছা থেকেই তিনি বাংলাদেশ থেকে দুবাই তারপর ইরান হয়ে তুরস্কে আসেন। তুরস্ক থেকে গ্রিস হয়ে সার্বিয়া এবং সার্বিয়া থেকে বসনিয়া পৌঁছান তিনি।
এভাবে আসতে অনেক কষ্ট হয় জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রায় আট-নয় মাস ধরে বসনিয়া আছি এবং ক্রোয়েশিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি।’
আর মাইনুদ্দীন জানান, দালালদের হাত ধরে তার ভাষায় ‘জিয়ারত ভিসায়’ প্রথম ইরাকে আসেন। ইরাকে পরিস্থিতি খারাপ দেখে আমি ইরান হয়ে তুরস্ক যাই। কিন্তু তুরস্কে আয়-রোজগারের পথ খুব একটা ভালো নয়। তাই সেখান থেকে গ্রিস, আলবেনিয়া হয়ে বসনিয়া এসে পৌঁছাই।
মাইনুদ্দীন এবং সালাউদ্দীন জানান, পশ্চিম ইউরোপের দেশ ইটালিতে পৌঁছার লক্ষ্য তাদের।
বসনিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে নানা ধরনের কষ্টের মুখে পড়েছেন বলে জানান এ দুই বাংলাদেশি। তারা বলেন, রাতের পর রাত জঙ্গল পাড়ি দিয়ে পানি ও খাবারের অভাবে কষ্ট করে তারা এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছেন।
বসনিয়া পর্যন্ত আসতে মোট চার বছর লেগেছে মাইনুদ্দিনের। তিনি বলেন, ইউরোপ অনেক সহজ মনে হয়েছিল। পাহাড়ে চড়তে হয়, সেই সঙ্গে থাকে পুলিশের পাহারা। মাসের পর মাস এভাবে চলতে অনেক কষ্ট হয়।
আর ক্যাম্পেও তাদের খাবারের কষ্টসহ নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘ভাত নিয়মিত খেতে পাওয়া যায় না। রুটি খেয়ে থাকতে হয়।’
অর্থনৈতিক বিষয়ে মাইনুদ্দীন জানান, দালালদের হাত ধরে টাকা আনাতে হয়। দালালদের হাত ধরে বাংলাদেশ থেকে টাকা আনাতে হলে অনেক টাকা দালালদের দিতে হয়।
‘দালালদের মাধ্যমে যদি আপনি দশ হাজার টাকা আনাতে চান তাহলে আপনার খরচ পড়বে ১৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ চার হাজার টাকা দালালদের দিতে হয়।’
আর কষ্টের বর্ণনা দিতে গিয়ে সালাউদ্দীন জানান, এখানে আসার পর যে কষ্ট হয় তা আগে জানলে তিনি এভাবে আসার চেষ্টা করতেন না।
‘গেম মারতে গিয়ে পুলিশের নির্যাতন’
গত আট নয় মাস বসনিয়ায় আছেন সালাউদ্দীন। এসময়ে বেশ কযেকবার তিনি ক্রোয়েশিয়া পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন কিন্তু ক্রোয়েশিয়া সীমান্তে পুলিশের নজর এড়াতে পারেননি।
‘প্রায় ৮-১০ বার গেম মারছি, কিন্তু ক্রোয়েশিয়া পুলিশের, মানে ধরা খেয়ে যাই পথে। এইখান থেকে যাইতে পারতেছি না, ইতালির দিকে।’
তাদের অভিযোগ, ক্রোয়েশিয়া পুলিশের হাতে ধরা পড়লে ভয়ানক নির্যাতন সইতে হয়।
মাইনুদ্দীন জানান, প্রায় মাস খানেক আগে তিনি সর্বশেষ ‘গেম মারার’ চেষ্টা করেছেন। গেম মারার বিষয়ে দালালরা সহযোগিতা করে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ক্রোয়েশিয়ার পুলিশ তো অনেক মারধর করে। মারধর মানে তারা এমন মার দেয় যে ফিল্মের মারকে হার মানাবে।’
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.