Beanibazarview24.com






অহী আলম রেজা ::
বাংলাদেশের জনপ্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমদ। বলা হয়, জনপ্রিয়তার দিক থেকে হুমায়ূন আহমেদ হচ্ছেন এ যুগের শরৎচন্দ্র। নিমাই ভট্টাচার্যের সমান তিনি। শৈশব কেটেছে সিলেট শহরে। এরপর প্রাণের টানে বার বার এসেছেন প্রিয় এ শহরে।
সিলেটকে খুব ভালোবাসতেন কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদ। সিলেটকে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ শহর বলেও মনে করতেন তিনি। সিলেটের ঘাস ফুল নদী ছিল তাঁর চিরচেনা। ২০১২ সালের এই দিনে আমাদের ছেড়ে না ফেরার দেশে চলে যান বাংলা সাহিত্যের এ প্রবাদপুরুষ।
হুমায়ুন আহমেদ ছিলেন স্বপ্নচারী মানুষ। স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্ন দেখাতেন। স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেয়ার দুরূহ সেই কাজটি অবলীলায় করেছিলেন নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। তিনি তাঁর স্বপ্নকে ছুঁয়েছেন বহুমাত্রিকতায়। অন্য অনেকের মতো স্বপ্নের প্রতি তারও পক্ষপাতিত্ব ছিল।
হাতের মুঠোয় স্বপ্ন নিয়ে তিনি তাতে জ্যোৎস্নার দুধেল রঙ মিশিয়েছেন। বৃষ্টি বিলাসের রিমঝিম শব্দে শুনেছেন স্বপ্নের গান। আর তাঁর এসব রঙ মাখানো স্বপ্নে বিভোর গোটা জাতি। বাংলা সাহিত্যাকাশে জ্বল জ্বলে অনেক নক্ষত্রের মধ্যে আলাদা এক দ্যুতিতে উজ্জ্বল ছিলেন নন্দিত এ লেখক। যার আলোক বিভায় বিকশিত ছিলেন অনেকে। হঠাৎ মহাজাগতিক অজানা এক ডাকে দ্যুতিময় সেই নক্ষত্রের পতন ঘটল। স্বপ্নের আকাশ থেকে ঝরে যায় উজ্জ্বল নক্ষত্রটি।
লেখালেখির শুরুতে হুমায়ূন আহমেদ রচনা করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’। আর এখান থেকেই শুরু হয় তাঁর নন্দন ভুবনের নন্দিত যাত্রা। স্বপ্নীল এই যাত্রায় তিনি হয়ে ওঠেন এক বিস্ময়কর জাদুকর। তার পাঠক এবং বিরাট ভক্তকুল তাঁর লেখনীতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে ওঠে। জাদুকরি দক্ষতায় তিনি তার লেখনী দিয়ে এ দেশে অসংখ্য পাঠক তৈরি করেন।
অনেকটা তাঁর কল্যাণেই এদেশের প্রকাশনা শিল্প একটা আলাদা মাত্রা পায়। তাঁর ফর্মকে অনুকরণ করে অনেকে লিখতে শুরু করেন। বাংলা সাহিত্যে শুরু হয় ভিন্ন এক ধারার যাত্রা। আর এই যাত্রায় পেছনে ফেরেননি বহুমাত্রিক হুমায়ূন আহমেদ। লেখক জীবনের শুরুতে উপন্যাসের নামকরণে যে ‘নন্দিত’ শব্দটি চয়ন করেছেন, তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্য দিয়ে তিনি হয়ে উঠেছেন নন্দিতজন।
হুমায়ুন আহমেদ তাঁর ‘কিছু শৈশব’ উপন্যাসে এভাবেই সিলেট শহর ও তাঁর বেড়ে ওঠা সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন।
উপন্যাসের ভূমিকায় হুমায়ুন আহমেদ লিখেছেন, “মানুষ যখন মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে তখন সে ব্যাকুল হয়ে পেছনে তাকায়। আমার মনে হয় তাই হয়েছে। সারাক্ষণই শৈশবের কথা মনে পড়ে। কী অপূর্ব সময়ই না কাটিয়েছি। বৃষ্টিতে ভেজা, লাফালাফি, পুকুরের পানিতে গোসল-এভাবেই কেটেছে হুমায়ুন আহমেদের শৈশব। এর জন্য মার বকুনিও খেতে হয়েছে তাকে।
হুমায়ুন আহমেদের স্মৃতির এই শহরে খানিকটা সময় কেটেছে মিরাবাজারে। বর্তমান কিশোরীমোহন প্রাথমিক বিদ্যালয়েই পড়াশোনার পাঠ শুরু। তখনকার সময় পাঠশালায় শিশুরা নানা ধরনের খেলা খেলত? সরঞ্জামহীন খেলা। মার্বেলের চল ছিল। তবে কোনো এক বিচিত্র কারণে মার্বেল বস্তুটিকে অভিভাবকরা সন্দেহের চোখে দেখতেন। পকেটে মার্বেলের ঝন ঝন শব্দ হলেই অবধারিত শাস্তি। মার্বেলের কাছাকাছি আরেকটা খেলা ছিল, চাড়া খেলা নাম। সিগারেটের খালি প্যাকেট দিয়ে আরেকটা খেলা ছিল। চাড়া খেলারই অন্য ভার্সন। এই খেলায় টাকা-পয়সা লেনদেন হতো। টাকা-পয়সা মানে সিগারেটের প্যাকেট। ক্যাপসটেন সিগারেটের প্যাকেটের মূল্যমান একশ টাকা, সিজার সিগারেটের প্যাকেট পঞ্চাশ টাকা। সবচেয়ে দামি ছিল থ্রি ক্যাসেল সিগারেটের প্যাকেট। খুবই কম পাওয়া যেত বলে এর দাম ছিল পাঁচ হাজার টাকা।
শৈশবের খেলার সাথি শঙ্কর (মাথা মোটা শঙ্কর নামে তাকে ডাকা হতো) সম্পর্কে হুমায়ুন আহমেদ বলেছেন, জীবন তাঁর প্রতি করুণা করেনি। পত্রিকার হকার এবং বাদামওয়ালা হয়ে সে কোনক্রমে জীবন টেনে নিচ্ছিল। পত্রিকায় পড়লাম শঙ্কর খুন হয়েছে। তাঁর মৃত্যু দেহ ভেসে উঠেছে এক পানা পুকুরে। কে বলবে এটাই হয়তো সেই পুকুর-যেখানে আমি শঙ্করকে নিয়ে দাপাদাপি করে শৈশব যাপন করেছি।
টগর নামের এক খেলার সাথির কথা মনে পড়ছে। আমার চেয়ে সে বছর খানিকের বড়। খেলাধুলায় অপটু, মারামারিতে অতি দুর্বল। সারাক্ষণ সে উপদেশ ও জ্ঞান বিতরণ করত। আমাকে সে একদিন গম্ভীর হয়ে বলল, আমার গায়ের রঙ কালো, কারণ আল¬াহ আমাকে মাটি দিয়ে বানিয়েছেন। আর তোমার গায়ের রঙ সাদা, কারণ তোমাকে গু দিয়ে বানিয়েছেন। ভালো করে শুকে দেখ গন্ধ পাবে।
আরেক বন্ধু ছিল মতি বা মতিন। তাকে দেখলেই মনে হতো সে নতুন কাপড় পরে বিয়ে বাড়িতে যাবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মধ্যে একমাত্র সেই সবসময় জুতা পরে বের হতো। রোগা দুর্বল ধরনের মেয়েলি চেহারার ছেলে। তার প্যান্টের পকেটে ঝকঝকে নতুন মার্বেল ভরতি থাকত। তবে সে নিজে মার্বেল খেলত না। একদিন সে বলল, ম্যাজিক দেখাবে। আমরা অতি আগ্রহে তাকে ঘিরে ধরলাম। সে একটা মার্বেল মুখে পুরলো। পরক্ষণেই হা করে দেখাল মুখে মার্বেল নেই। আমরা অবাক হলাম না। বোঝাই যাচ্ছে সে মার্বেল গিলে ফেলেছে। তাকে চেপে ধরতেই সে স্বীকার করল। আমরা বললাম, এই ম্যাজিকটা আবার দেখব। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে আরেকটা মার্বেল গিলল। আমরা মহাআনন্দিত। বিপুল করতালি। এর পর থেকে তার প্রধান কাজ মার্বেল গিলে আমাদের আনন্দ দেওয়া। আরেক বন্ধু টগর একদিন আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, মেয়েদের পেট দিয়ে বাচ্চা কীভাবে বের হয় জানিস? আমি বললাম-জানি। জানলে বল কীভাবে হয়? আমি বললাম, পেট কেটে বের করা হয়। টগর বলল, তুই কিছুই জানিস না, বাচ্চা বের হয় মেয়েদের পাছা দিয়ে।
মেয়েদের মধ্যে সবচে’ যার কথা বেশি মনে পড়ে তিনি হচ্ছেন পারুল আপা। তার চেহারা মনে নেই। ফর্সা লম্বাটে মুখ-এইটুকু শুধু মনে আছে। পারুল আপা আমাকে খুব আদর করতেন। কেন করতেন জানি না? বাংলা সাহিত্যের লেখকদের স্বাধীনতা কম বলেই হয়তো বলা সম্ভব হবে না।
আমাদের পাড়ায় এক বিহারি পরিবার থাকত। তাদের তিন মেয়ে, তিনটাই পরির মতো সুন্দর। মেয়ে তিনটা কারো সঙ্গে মিশত না। বাড়ির ভেতর ঘুর ঘুর করত। ওই বাড়িতে আমার খুব যাতায়াত ছিল। তিন বোনের মধ্যে ছোট দু’জনকেই আমি আলাদাভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছি। যতদূর মনে পড়ে দু’জনই মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়েছে।”
এইভাবেই হুমায়ুন আহমেদের বেড়ে ওঠা। বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কেটেছে শৈশব-কৈশোর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষে সেখানেই অধ্যাপনা শুরু করেন। সমানে চলতে থাকে লেখালেখি। উপন্যাস, গল্প, নাটক, গান, চলচ্চিত্র নির্মাণ। এছাড়া দেশের বিভিন্ন সমস্যায় বিবেকের ভূমিকা পালন করেছেন। কলাম লিখেছেন পত্রিকায়। ২০০০ সালে সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হলের নামকরণ নিয়ে সিলেটের রাজনীতি তখন উত্তাল। নামকরণের পক্ষে বিপক্ষে আন্দোলন চলতে থাকে। আবারও স্মৃতির শহর সিলেটে আসেন কালজয়ী সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ। নামকরণবিরোধীদের অপতৎপরতার প্রতিবাদে তিনি ২০০০ সালের ২৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে অনশন করেন। সে সময় হুমায়ুন আহমেদের অনশনে একাত্মতা ঘোষণা করেন প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাহিতিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও সাধারণ মানুষ। ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল হুমায়ুন আহমেদের এই অনশন কর্মসূচি।
জনপ্রিয় এ কথাসাহিত্যিক আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি বেঁচে থাকবেন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের হৃদয়ে, সিলেটবাসীর হৃদয়ে। হুমায়ুন আজাদের ভাষায় বলা যায়Ñ
‘ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো ফুল
ভালো থেকো ধান, ভাটিয়ালি গান, ভালো থেকো…
ভালো থেকো নাও, মধুমাখা গাঁও, ভালো থেকো
ভালো থেকো মেলা, লাল ছেলে বেলা, ভালো থেকো…
ভালো থেকো হুমায়ুন আহমেদ, ভালো থেকো।’
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.