Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

এক বিশ্বজয়ী বাঙালি বীরের প্রস্থান, ফিলিস্তিনিরা শোকাহ’ত


“লিভিং ঈগলের” খ্যাত বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) সাইফুল আজমের মৃ’ত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন ফিলিস্তিনের নাগরিকরা। ফিলিস্তিনের প্রকৃত বন্ধু উল্লেখ করে তাঁর মৃ’ত্যুতে শোক প্রকাশ করেন তারা।

ফিলিস্তিনের ইতিহাসবিদ ওসামা আল আশকার সাইফুল আজমকে অসাধারণ প্রতিভাধর বিমান সেনা উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লিখেন, ‘বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ইয়েরা আল-আকসা মসজিদকে প্রতিরোধ ও প্রতিরোধে আমাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছেন।’

ফিলিস্তিনের অধ্যাপক নাজি শাউকরি টুইটারে সাইফুল আজমের মৃ’ত্যুতে শোক প্রকাশ করেন। তিনি লেখেন,”সাইফুল আজম ফিলিস্তিনকে ভালোবাসতেন এবং জেরুজালেমের স্বার্থে লড়াই করেছিলেন”। এছাড়া ফিলিস্তিনের খ্যাতনামা সাংবাদিক তামের আল-মিশাল সাইফুল আজমকে ‘আকাশের ঈগল’ বলে উল্লেখ করেছেন।

উল্লেখ্য, সাইফুল আজম ছিলেন, পৃথিবীর ২২ জন “লিভিং ঈগলের” মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। নিজ জীবদ্দশায় তিনি চারটি দেশের (জর্ডান, ইরাক, পাকিস্তান, বাংলাদেশ) পাইলট হয়ে আকাশে রাজত্ব করেছেন, ভূপতিত করেছেন সর্বোচ্চ সংখ্যক ইজরায়েলি ফাইটার! ভারত এবং ইজরায়েলে পাইলটদের চোখে তিনি ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক!

পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় ১৯৬৭ সালের জুন মাসে তৃতীয় আরব-ইসরাইল যু’দ্ধ শুরু হয়। যু’দ্ধে অংশ নিতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ইরাকি বিমানবাহিনীতে বদলি হন সাইফুল আজম। পশ্চিম ইরাকে অবস্থান নিয়ে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে যু’দ্ধ করছিলেন তিনি।

যু’দ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র ৫ দিনের মাথায় গাজা এবং সিনাইয়ের কর্তৃত্ব নিয়েছিল ইসরাইল। জুনের ৫ তারিখে সিরিয় বিমানবাহিনীর দুই-তৃতীয়াংশ শক্তি ধ্বংস করে দেয় ইসরাইলি বিমান সেনারা। তেমন কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ইসরাইল পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেম তারা দখল করেছিল। দখল করেছিল সিরিয়ার গোলান মালভূমিও। তাদের সামনে বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ তৈরি করতে পারেনি মধ্যপ্রাচ্যের কোনো দেশ। এ সময় ইসরাইলিদের যমদূত হয়ে জর্ডানে যান সাইফুল আজম।

৬ জুন আকাশ থেকে প্রচণ্ড আক্র’মণে মিসরীয় বিমানবাহিনীর যু’দ্ধ-সরঞ্জাম গুঁড়িয়ে দেয় ইসরাইলি বাহিনী। একই দিন বেলা ১২টা ৪৮ মিনিটে চারটি ইসরাইলি সুপারসনিক ‘ডাসল্ট সুপার মিস্টেরে’ জঙ্গি বিমান ধেয়ে আসে জর্ডানের মাফরাক বিমান ঘাঁটির দিকে। এবার তাদের লক্ষ্য জর্ডানের ছোট্ট বিমানবাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া।

সে সময় ইসরাইলি সুপারসনিকের বিরু’দ্ধে ল’ড়াই চালিয়ে যাওয়ার মতো সমকক্ষ বিমান আরবীয়দের ছিল না। তবু ইসরাইলিদের ঠেকাতে মাফরাক বিমান ঘাঁটি থেকে ‘হকার হান্টার’ জঙ্গি বিমান নিয়ে বুক চিতিয়ে উড়াল দেন সাইফুল আজম।

আর সেই হকার হান্টার দিয়েই ক্ষিপ্রগতির দুটি ইসরাইলি সুপারসনিক ঘা’য়েল করে ফেললেন সাইফুল আজম। তার অব্যর্থ আঘা’তে ভূপাতিত হয় একটি ইসরাইলি ‘সুপার মিস্টেরে’। আরেক আ’ঘা’তে প্রায় অকেজো হয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে কোনো মতে পালিয়ে ইসরাইলি সীমানায় গিয়ে আছড়ে পড়ে আরেকটি বিমান।

সে দিন অকুতোভয় বৈমানিক সাইফুল আজমের অকল্পনীয় বীরত্বের কারণে ইসরাইলের পুরো পরিকল্পনাই ভেস্তে যায়। উল্টো নিজেদেরই দুটো বিমান হারায় তারা।

এমন বীরত্বের জন্য পুরস্কারস্বরূপ সাইফুল আজমকে ‘হুসাম-ই-ইস্তিকলাল’ সম্মাননায় ভূষিত করে জর্ডান সরকার। সাইফুল আজমের কাছে ইসরাইলি বৈমানিকদের ধরাশায়ী হওয়া এটাই প্রথম। পরদিনই তার কৃতিত্বে ইরাকি বৈমানিক দলের কাছে চরমভাবে পরাজিত হয় ইসরাইলিরা। ৭ জুনে ইরাকের ‘এইচ-থ্রি’ ও ‘আল-ওয়ালিদ’ ঘাঁটি রক্ষা করার দায়িত্ব পড়ে এক ইরাকি বৈমানিক দলের কাঁধে। আর সাইফুল আজম সেই দলের অধিনায়ক।

সে দিন চারটি ‘ভেটোর বোম্বার’ ও দু’টি ‘মিরেজ থ্রিসি’ জঙ্গি বিমান নিয়ে আক্র’মণ চালায় ইসরাইল। একটি ‘মিরেজ থ্রিসি’ বিমানে ছিলেন ইসরায়েলি ক্যাপ্টেন গিডিওন দ্রোর। দ্রোরের ‘গু’লিতে নিহ’ত হন আজমের উইংম্যান। তার হা’মলায় ভূপাতিত হয় দুটি ইরাকি বিমান। পরক্ষণেই এর জবাব দেন আজম।

তার অব্যর্থ টা’র্গেটে পরিণত হয় দ্রোরের ‘মিরেজ থ্রিসি’। সে আঘা’তের পর বাঁচার উপায় না পেয়ে যু’দ্ধব’ন্দি হিসেবে ধরা দেন ক্যাপ্টেন দ্রোর। ওই যু’দ্ধব’ন্দির বিনিময়ে জর্ডান ও ইরাকের সহস্রাধিক সৈ’ন্যকে মুক্ত করে ইসরাইল। আরব-ইসরাইল যু’দ্ধের প্রথম ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই সাইফুল আজম একটি অনন্য রেকর্ড তৈরি করেন। ইতিহাসে তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ভূপাতিত করেছেন সর্বোচ্চ তিনটি ইসরাইলি বিমান। যে জন্য ‘নাত আল-সুজাহ’ সামরিক সম্মাননায় ভূষিত করা হয়।

সাইফুল আজমই পৃথিবীর ইতিহাসে একমাত্র বৈমানিক যিনি চারটি দেশের বিমানবাহিনীর সৈ’ন্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই চারটি দেশ হলো পাকিস্তান, জর্ডান, ইরাক ও বাংলাদেশ। এ ছাড়া আটটি ভিন্ন দেশের আট বাহিনীর বিমান পরিচালনা করেছেন আজম। যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, জর্ডান, ইরাক, রাশিয়া, চীন ও নিজ মাতৃভূমি বাংলাদেশের হয়ে বিমান চালিয়েছেন তিনি।

১৯৭১। পৃথিবীর নানা প্রান্তে যু’দ্ধ করা সাইফুল আজম নিজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা যু’দ্ধে অংশ নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন মুক্তিযু’দ্ধে যোগ দেবার। ৭১ সালের শুরুতেই আজমকে ‘গ্রাউন্ডেড’ করে রাখে বিমান বাহিনী। ‘গ্রাউন্ডেড’ মানে হলো, একজন পাইলটকে সাময়িকভাবে উড্ডয়নে নিষেধাজ্ঞা জারি করা।

আজম ছিলেন বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের প্রশিক্ষক। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য স্বল্প আলোচিত রয়ে গেছে, সেটি হলো, মু’ক্তিযু’দ্ধ শুরু হবার ঠিক আগে আগেই আজম নিজেও পাকিস্তান এয়ারলাইন্স ও বিমান বাহিনীতে তার সহকর্মী বাঙালিদের সাথে গোপনে পরিকল্পনা করছিলেন করাচি থেকে পাকিস্তান এয়ারলাইন্সের একটি জেটবিমান ছিনতাই করার। পরিকল্পনা অনুযায়ী মার্চের ৬ তারিখেই তিনি তার স্ত্রী ও সন্তানকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ঢাকায়। দুর্ভাগ্য, পরবর্তীতে সে পরিকল্পনা আর সফল করতে পারেন নি।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের পরিকল্পনার কথাও জানতেন আজম। বিমান ছিনতাইয়ের গোপন পরিকল্পনা করার সময় তার সাথে আলাপ করেছিলেন মতিউর। ‘টি-৩৩’ জঙ্গী বিমান নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় মতিউর শহীদ হবার পর পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আজমকে রিমান্ডে নেয় এবং টানা ২১ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। স্বাভাবিকভাবেই সেই চরম মুহূর্তে যে কোনো সময় মৃ’ত্যুদ’ণ্ড হতে পারত তার। কিন্তু সামরিক সম্মাননা প্রাপ্ত খ্যাতিমান বৈমানিক হওয়ার কারণে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে পাকিস্তান। একই সাথে তাকে মৃ’ত্যুদ’ণ্ড প্রদান না করার জন্য পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল এ রহিম খান ও জর্ডানের বাদশাহ হুসেইনের অনুরোধ ছিল বলেও ধারণা করা হয়। গোটা যু’দ্ধ চলাকালীনই আজমকে রুদ্ধ করে রাখা হয় যাতে তিনি যোগ দিতে না পারেন স্বাধীনতা সংগ্রামে।

যু’দ্ধক্ষেত্রে অনন্য সব অর্জন আর ইতিহাস গড়া সাইফুল আজমকে ২০০১ সালে ইউনাইটেড স্টেটস এয়ার ফোর্স বিশ্বের ২২ জন ‘লিভিং ইগলস’-এর একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। সাইফুল আজমের জন্ম ১৯৪১ সালে, পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়াতে। বাবার কর্মসূত্রে শৈশবের কিছু সময় তার কাটে কলকাতায়। ১৯৪৭ এর দেশভাগের সময় তার পরিবার আবার ফিরে আসে বাংলাদেশে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মাধ্যমিকের পড়াশোনা করেন এখানেই।

রবিবার (১৪ জুন) দুপুর ১টায় ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের আইসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃ’ত্যুবরণ করেন।

You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.