Beanibazarview24.com
করোনাভাইরাসের কারণে অনেক প্রবাসীই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে পরিবারের সঙ্গে মিলিত হতে পারেননি। সদ্য ভূমিষ্ট সন্তানকে দেখার জন্য অনেকের হৃদয় কেঁদে উঠছে। আবার কেউ কেউ অসুস্থ মা-বাবার পাশে থাকার জন্য ছটফট করছে। আর এসব কারণেই আজকাল অনেকেই প্রতিদিন প্রশ্ন করেন, ভাই কবে দেশে যেতে পারব।
কেউ দেশে যাওয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমার ভেতরটা কেঁপে উঠে। কারণ আমারও মার্চে দেশে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করোনার কারণে যাওয়া হয়নি। আসলে আমি যাইনি চাকরি হারানোর ভয়ে। দেশে গিয়ে বেকার হওয়ার ভয়ে।
বিমানে উঠার পরই আমার নাম হয়ে গেছে প্রবাসী। তবে নিজের দেশকে ভালোভাবে চিনেছি বিদেশে এসে। এখানে আসার পর দেশের অতি তুচ্ছ সব ঘটনাও অপূর্ব বলে মনে হচ্ছে। মায়ের বকুনি, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, মহল্লার দোকানে বসে চা খাওয়া, বৃষ্টিতে ভিজে ফুটবল খেলা, দলবেঁধে মসজিদে নামাজ আদায় করতে যাওয়া।
ভরা জ্যোৎস্না রাতে বন্ধুদের সঙ্গে দলবেঁধে ঘুরে বেড়ানো, রাত-জেগে ওয়াজ শোনা, পাড়াপড়শি মারা গেলে জানাজায় শরীক হওয়া এসব তখন খুবই তুচ্ছ মনে হত। কিন্তু প্রবাসে আসার পর এগুলোর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। একাকী সময় স্মৃতির খাতায় এই ক্ষুদ্র কর্মগুলো আমাকে আনন্দের মহাসমুদ্রে ভাসিয়ে বেড়ায়। নিজের দেশকে পৃথিবীর সেরা দেশ মনে হয়।
এখনো আমার মনে পড়ে বাঁধানো পুকুরঘাটে স্নানান্তে আর্দ্রবস্তে কোনো তরুণী, বধূ কিংবা কলসি কাঁখে কোনো গৃহিণীর ঘরে ফেরার ছবি। মাঠের ধারে গবাদিপশু চরে বেড়ানো, রজনীগন্ধা ফুলের সুগন্ধ, সন্ধ্যায় হাঁসমুরগির গৃহে প্রত্যাবর্তন। এই ক্ষুদ্র ব্যাপারগুলি দেশে থাকতে কখনো অনুভব করিনি। মাঝে মধ্যে মনে হয় এ এক অন্যরকম ভালোলাগা অনুভূতি, যে এই অনুভূতির আস্বাদ পায় নাই তার মতো হতভাগ্য বুঝি কেউ নাই।
দেশের জন্য মনটা আজকাল কেমন কেমন জানি করে। এ শুধু আমার না সকল প্রবাসীরই এমনটা অনুভব হচ্ছে। এ অনুভূতি লিখে প্রকাশ করার মতো না। আমার মনে হয় যারা চিরকাল গ্রামে বসবাস করেন কিংবা বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায় না তারা উপলব্ধি করতে পারবে না আমাদের অনুভূতি। তারা হয়ত ব্যঙ্গ করে বলবে এতই যখন অনুভূতি তাহলে দেশে ফিরে আসলেই হয়। তারা হয়ত জানে না প্রতিটা প্রবাসী স্বপ্ন বুননের কারিগর, তারা সেই স্বপ্ন বুনতে বুনতেই দেখে কয়েক যুগ কেটে গেছে তখন আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করে না।
যারা আত্মীয়-স্বজনহীন একাকী প্রবাসে বাস করে তারা জানে বাংলাদেশের জন্য, প্রিয় সন্তানের জন্য, প্রিয়তমার জন্য, নিজের গ্রামের জন্য, দেশের জন্য, নিজের পোষা প্রাণীর জন্য মনটা কি রকম হু হু করে।
ইদানীং পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, নিজ গৃহের জন্য মনটা বেশি রকম হাহাকার করছে। সারাক্ষণ ভাবি কবে যে মহামারি আমাদের মুক্তি দেবে, কবে যে এই প্রবাস জীবন থেকে মুক্তি পাব। সেখানে মায়ের হাতের রান্না খাব, নিস্তব্ধ অপরাহ্নে বিস্তীর্ণ মাঠে একটু হাঁটাহাঁটি করব, বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেব, প্রিয় আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে কতকাল পর আবার দেখা হবে। এসব ভাবনা ধীরে ধীরে সে অনুভূত আনন্দের বন্যা আমার মনে কূল ভাসিয়ে দোলা দিয়ে যায়।
প্রায় তিনবছর বাংলাদেশে যাই না। দেশের জন্য মনটা উতলা হয়ে আছে। অফিস শেষে বাসায় ফিরে মনটা আরো বেশি রকম খারাপ হয়ে যায়। আসলে যেখানে নারীর হাতের স্পর্শ নাই সেখানে গৃহ বলে মনে হয় না, সবকিছুই কেমন লক্ষ্মী ছাড়া উদাস ধূ ধূ প্রান্তর মনে হয়।
দেশে প্রত্যাবর্তন করব ভাবলেই মনের মধ্যে অনুভূত আনন্দের বন্যা বয়ে চলে। সিঙ্গাপুরের প্রবাসী লেখক শরীফ ভাই সেদিন বললেন, প্রবাসীরা দেশে ছুটিতে যাওয়ার সময় তার চোখে মুখে যেই আনন্দের ঝিলিক দেখা দেয় তা যদি প্রিয়জনরা অনুভব করতে পারত তাহলে তাকে আর কখনই প্রবাসে আসতে দিতো না।
Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.