Sunday, July 6, 2025

Top 5 This Week

Related Posts

মনু মিয়ারাই সমাজের প্রকৃত নায়ক

তিন হাজারেরও বেশি কবর খুঁড়েছেন মনু মিয়া। পেশায় গোরখোদক, বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন, এখন শয্যাশায়ী হাসপাতালে। তার দীর্ঘদিনের সঙ্গী, যাতায়াতের একমাত্র ভরসা, নিজ হাতে কেনা ঘোড়াটি মারা গেছে—কে বা কারা মেরে ফেলেছে, জানেন না তিনি।

এই খবর শুনে ছোটপর্দার জনপ্রিয় অভিনেতা খায়রুল বাসার ছুটে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে দেখা করতে। কথা হয় দীর্ঘ সময় ধরে, যেখানে উঠে আসে মনু মিয়ার জীবনদর্শন, আত্মমর্যাদা আর নিঃস্বার্থ সেবার এক অনন্য গল্প।

বাসার জানান, হাসপাতালে গিয়ে মনু মিয়াকে দেখে মনে হয়েছে, এ মানুষ ভাঙবার নন। শারীরিকভাবে দুর্বল হলেও মানসিকভাবে অত্যন্ত দৃঢ়। ঘোড়ার মৃত্যুর পর তার পাশে দাঁড়াতে গিয়ে বাসার তাকে একটি নতুন ঘোড়া কিনে দিতে চাইলেও মনু মিয়া তাতে রাজি হননি। মনু মিয়া বলেন, ‘সুস্থ হয়ে বাড়ি গেলে সাতটা ঘোড়া কিনতে পারব।’

এই জবাবে বিস্মিত হন বাসার। তিনি বোঝেন, মনু মিয়া দান নিতে চান না। জীবনভর সাধনার ফসল দিয়ে নিজের শখ পূরণ করেছেন। শখের পেছনে লক্ষাধিক টাকা ব্যয় করেছেন তিনি। তার সংগ্রহে রয়েছে হাতির দাঁত দিয়ে বানানো ছুড়ি, হরিণের শিংয়ের লাঠি, দামি চাবুক—সবই শখ পূরণের নিদর্শন। তবে মনু মিয়া কখনোই ঘোড়াকে আঘাত করেননি।

ঘোড়া হারিয়ে তিনি কষ্ট পাননি, এমনটা নয়। কিন্তু তার ভাষায়, ‘যার আছে, তারই যায়। কপালে লেখা ছিল, তাই গেছে। কে মারল, দেখিনি, কাকে দোষ দেব?’ এমন ভাবনার মানুষ সমাজে আজ বিরল।

ঘোড়াপ্রেমী এই মনু ১০ মণ ধানের কুড়া, ১০ মণ খড় কিনেছিলেন ঘোড়ার খাবারের জন্য। বাসার বলেন, ‘কথা বলতে গিয়ে একসময় তিনি চুপ ছিলেন। পরে বলতে থাকেন, ‘আমি অসুস্থ হয়ে ঢাকা, এখানে শুনি ঘোড়াটা মারা গেছে। আমার চেয়ে আমার পরিবারের লোকদেরও অনেক কষ্ট হচ্ছে। পরিবারের লোকেরা ঘোড়াকে পালে। আমি তো ঢাকায়, বাড়িতে গেলে কান্না পাবে।’ আমি তাকে আবার বললাম ঘোড়া কিনে দেওয়ার কথা, তিনি রাজি নন। তিনি বাড়ি যেতে পারলে নিজেই আবার শখ মেটাবেন।’

বর্তমানে মনু মিয়া ডায়াবেটিস ও কোমরব্যথা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি এই অভিনেতাকে জানান, তার কোনো শত্রু নেই। তিনিও কখনো মনে করেন না কেউ তার ক্ষতি করতে পারেন। তিনি সবাইকে আপন মনে করেন। এ জন্যই তিনি ছুটে যান সবার করব খুঁড়তে। বাসার বলেন, তিনি অসুস্থ হয়েছেন অনিয়মের জন্য। যদি রাতে খাওয়ার পরে শোনেন কাল কোথায় কবর খুঁড়তে যেতে হবে। পরে তিনি আর কিছুই খেতে পারেন না। পরের দিন করব দেওয়া শেষ হলে সন্ধ্যায় এসে বাড়িতে খান। মৃত্যুবাড়িতে তিনি কিছু খান না। এমনকি কোনো টাকাও কোনো দিন নেন না। খাবারের অনিয়ম করেন। মানুষের পাশে থাকাটাই তার কাছে প্রথম।

অনেকেই তাকে ঘোড়া উপহার দিতে চাইলেও মনু মিয়া তাতে রাজি নন। শেষবার শুধু একটি ইচ্ছার কথা জানান- হজে যেতে চান তিনি, সেটাও নিজের সামর্থ্যেই।

বাসারের উপলব্ধি মনু মিয়ারাই সমাজের প্রকৃত নায়ক। অভিনেতা বলেন, ‘এমন মানুষের কথা শুনলে জটিলতায় ভরা দুনিয়া অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি তারা নিঃস্বার্থভাবে আলাদা দায় অনুভব করেন। যা আমাদের এই সমাজে সবার জন্য অনুসরণীয়। মনু মিয়াই আমাদের এক উজ্জ্বল আদর্শ হয়ে উঠেছেন। মনু মিয়া নায়ক হতে চাননি। তার মহৎ কাজ তাকে আমাদের নায়ক করে তুলেছে। এই দিশাহীন সমাজে তার মতো খাঁটি সোনার মানুষের অভাব।’

মনু মিয়ার জীবন কাহিনি মানবিকতা, আত্মসম্মান ও সমাজসেবার এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি—যা আমাদের সবাইকে ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে একটি সুন্দর সমাজ গড়ার।

Popular Articles