প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সিলেটের তরুণদের চোখে একটাই স্বপ্ন—বিলেত বা প্রবাস। স্থানীয়ভাবে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান ও শিল্পায়নের অভাবে এই স্বপ্নই তাদের একমাত্র অবলম্বন। উচ্চশিক্ষাকে মাধ্যম বানিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর সেই স্বপ্নে এবার বড় ধাক্কা দিয়েছে উচ্চ মাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার ফলাফল। চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষায় সিলেট বোর্ডে বিগত ১২ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পাসের হার তরুণদের মধ্যে তীব্র হতাশা সৃষ্টি করেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপ, আমেরিকার মতো দেশগুলোর কঠোর ভিসা নীতি, যা তাদের ভবিষ্যৎকে এক গভীর অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে সিলেট শিক্ষা বোর্ডে পাসের হার মাত্র ৫১.৮৬ শতাংশ, যা গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন। গত বছর এই হার ছিল ৮৫.৩৯ শতাংশ। শুধু তাই নয়, জিপিএ-৫ প্রাপ্তির সংখ্যাও কমে ১,৬০২ জনে দাঁড়িয়েছে, যা দেশের সকল বোর্ডের মধ্যে সর্বনিম্ন। এই ফল বিপর্যয়ে হাজারো শিক্ষার্থীর বিদেশে উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা ভেস্তে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে।
সিলেট শহর ও বিভিন্ন উপজেলার অনেক শিক্ষার্থী ফলাফলের আগেই বিদেশে ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে আইইএলটিএস কোচিং শুরু করেছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল, এইচএসসির ফল হাতে পেলেই স্বপ্নের দেশে পাড়ি জমানো। কিন্তু অপ্রত্যাশিত এই ফল তাদের সব পরিকল্পনা এলোমেলো করে দিয়েছে।
কানাইঘাটের শিক্ষার্থী আরিফুর রহমান হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমার ইংরেজিতে ‘এ’ গ্রেড এসেছে, কিন্তু অন্য একটি বিষয়ে ফেল করেছি। পরীক্ষার পর পরই আইইএলটিএস কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম রেজাল্টের পর পরীক্ষা দিয়ে জানুয়ারির সেশনে আবেদন করবো। এখন সব অনিশ্চিত। আমি বোর্ড চ্যালেঞ্জ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
একইভাবে গোলাপগঞ্জের শিক্ষার্থী সালমা আক্তার বলেন, “আমার দুটি বিষয়ে খারাপ হয়েছে। বাড়িতে সবাই আশা করেছিল আমি ভালো ফল করে লন্ডনে পড়তে যাব। এখন কী হবে জানি না। এখানে তো ভালো কোনো চাকরির সুযোগ নেই, আর বিদেশে যাওয়ার রাস্তাও বন্ধ হয়ে গেল।”
সিলেট প্রবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চল হলেও এখানে শিল্পায়নের চিত্র হতাশাজনক। হাতেগোনা কয়েকটি শিল্প-কারখানা থাকলেও সেখানে স্থানীয় তরুণদের কর্মসংস্থান নগণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, প্রবাসী আয়ে সিলেট জেলা শীর্ষে থাকলেও সেই অর্থ উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রবাসীদের পাঠানো বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স মূলত জমি কেনা, বিলাসবহুল বাড়ি তৈরি এবং ভোগ-বিলাসে ব্যয় হচ্ছে। অনেক প্রবাসী কোটি টাকা খরচ করে বিশাল বাড়ি তৈরি করলেও সেগুলো খালি পড়ে থাকে। এই অলস অর্থ সঠিক পথে বিনিয়োগ না হওয়ায় স্থানীয়ভাবে কর্মসংস্থান তৈরি হচ্ছে না। ফলে তরুণদের মধ্যে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। সিলেটের গ্রামগুলোতে গেলে ২০ বছরের বেশি বয়সী তরুণদের খুঁজে পাওয়া মুশকিল, কারণ তাদের বড় একটি অংশ বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে বা যাওয়ার চেষ্টায় আছে।
যে সময়টাতে তরুণরা দেশীয় কর্মসংস্থানের অভাবে বিদেশে যাওয়ার দিকে ঝুঁকছে, ঠিক সেই সময়েই উন্নত দেশগুলো তাদের দরজা সংকুচিত করছে। সম্প্রতি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশ স্টুডেন্ট ভিসার নিয়মকানুন কঠোর করেছে। টিউশন ফি বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্ভরশীলদের (ডিপেন্ডেন্টস) ভিসা বন্ধ এবং আর্থিক স্বচ্ছলতার প্রমাণপত্র আরও কঠিন করায় মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের জন্য বিদেশে যাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে সুযোগের অভাব এবং বিদেশে যাওয়ার পথে একের পর এক প্রতিবন্ধকতা সিলেটের তরুণদের এক গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করছে। অনেকে উপায়ন্তর না দেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করেন।