‘আমার নাতনিকে খুঁজে দাও। আমার এতিম নাতনি কোথায় আছে? আরও কয়েক জায়গায় খুজেঁছি’। কথাগুলো ঢাকার উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মা-বাবাহারা নাতনি শারমিনকে খুজঁতে আসা দাদা হারুণের।
‘আমার নাতনির কোনো ছবি নাই, আমার কোনো মোবাইল নাই, আমার নাতনি ক্লাস এইটে পড়ে’, বলতে বলতে চোখ মুছছিলেন ৬৫ বয়সী এই বৃদ্ধ।
সোমবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান দুপুর ১টা ৬ মিনিটে উড্ডয়ন করার পর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একটি ভবনের ওপর আছড়ে পড়ে এবং আগুন ধরে যায়। এতে স্কুলের অনেক শিক্ষার্থী আহত এবং অনেকে নিহত হয়। অনেকে গুরুতরভাবে দগ্ধ হয়। আহতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আহতদের মধ্যে ১৬০ জনকে নিয়ে আসা হয় উত্তরার আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তবে সেখানে আগুনে পোড়া রোগীদের চিকিৎসার ব্যবস্থা না থাকায় বেশিরভাগ রোগীকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে।
হাসপাতাল প্রাঙ্গণে কথা হয় শিশুদের খোঁজে আসা অভিবাবকদের সঙ্গে।
হারুণ বলেন, নাতনিকে খুজঁতে গাজীপুর থেকে এসেছি। আমার নাতনি শারমিন মাইলস্টোন স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। বাবা-মা ছোটবেলায় মারা যাওয়ার পর নাতনিকে নিজের কাছে রেখে বড় করেছি।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে জানায় এখানে শারমিন নামে কেউ নেই। একজন কর্মচারীও তাকে জানান, শারমিন নামের কেউ সেখানে নেই। ওনাকে (হারুণ) ঢাকা মেডিকেল বা বার্ন ইউনিটে পাঠানোর চেষ্টা করছি। কোনো অ্যাম্বুল্যান্স বা গাড়ি পেলে ওনাকে পাঠিয়ে দেবো।
হারুণের মতোই সন্তান, স্বজনের খোঁজে উত্তরার হাসপাতালটিতে অনেককে ভিড় করতে দেখা যায়। তবে হাসপাতালটির ভেতরে ও বাইরে তখন হাজারো মানুষের জটলা। কেউ কেউ হাসপাতালে ঢুকতে কাকুতি মিনতিও করেন। মোবাইলে ছবি নিয়ে খোঁজ করতেও দেখা যায় অভিবাবকদের। কাউকে স্কুলের শিক্ষক ও অন্য অভিবাবকদেরও ফোন করতে দেখা যায়।
এসময় মাইকিং করতে শোনা যায়, এখানে কোনো সিরিয়াস রোগী নেই। রোগী না পেলে বার্ন ইউনিটে যোগাযোগ করুন।
আরেক নারী এসে বলেন, আমার বোনের মেয়ে মাহফুজাকে খুঁজে বেড়াচ্ছি। এসময় একজন স্বেচ্ছাসেবী তাকে জরুরি বিভাগের ভেতরে নিয়ে যান।
সায়মাকে খুঁজতে হাসপাতালে এসেছেন তার দুই বোন পারভীন ও মুক্তি। তাদের মাঝে চাপা ভয় বোনকে হারানোর।
তারা জানান, শিক্ষক ও অন্যান্য অভিভাবক কেউ তার বোনের খোঁজ দিতে পারছেন না।
বিকাল ৪টায় হাসপাতালটিতে জবা নামে এক শিশুর আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ করেন ভলেন্টিয়াররা।
মাইলস্টোন স্কুলের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী রিজভীকে খুঁজতে হাসপাতালের প্রতিটি ফ্লোর দৌড়ে বেড়াচ্ছিলেন তার চাচা।তিনি বলেন, আমার ভাতিজা স্কুলে গিয়েছিল। দুর্ঘটনার কথা শুনে স্কুলে যাই। সেখান থেকে বলা হয় সবাইকে বিভিন্ন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এজন্য আমরা দুপুর দেড়টা থেকে উত্তরার বিভিন্ন হাসপাতালগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এদিকে তৃতীয় শ্রেণির নিধিকে খুঁজছিলেন তার বাবা ফারুক। বিভিন্ন হাসপাতালে নিজের সন্তানকে খুঁজে না পেয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন তিনি। অন্যদিকে, শিক্ষার্থী জাহেরাকে স্কুল থেকে আনতে গিয়ে নিখোঁজ হন মা লামিয়া আক্তার। সামান্য আহত অবস্থায় জাহেরাকে পাওয়া গেলেও মায়ের খোঁজে হাসপাতালগুলোতে যাচ্ছেন স্বজনরা।
৮ম শ্রেণির ছাত্র ফাহাদ সামান্য আহত হয়েছেন। এই শিক্ষার্থী বলেন, ক্লাস ছুটির ৫-৬ মিনিট পর বিমান আছড়ে পড়ে স্কুল ভবনে। আমি ভেতরে থাকলে আহত কিংবা নিহত হতে পারতাম। আমার দুই বন্ধু নিহত হয়েছে।
হাসপাতালের প্রত্যক্ষদর্শী কর্মচারীরা জানান, দেড়টার পর থেকেই প্রচুর আহত হাসপাতালটিতে আসতে থাকে। এর মধ্যে মৃত দুইজন ছিল। আহতদের সবাই আগুনে পোড়া। কারও কারও শরীরের চামড়া পুরো পুড়ে গেছে।
হাসপাতালটির চিকিৎসক জোবায়ের বলেন, রোগীদের মধ্যে ৬-৯ বছর বয়সীই বেশি। এখন যারা আছে তাদের স্যালাইনে রাখা হয়েছে। বেশিরভাগের অবস্থা আশঙ্কাজনক। এখানে আসার সঙ্গে সঙ্গে তাদের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে উত্তরার হাসপাতালগুলো থেকে রোগীদের নিয়ে ঢাকা মেডিকেলের দিকে ছুটে চলছে একের পর এক অ্যাম্বুলেন্স। রোগী পৌঁছে দিয়ে ফেরত আসা অ্যাম্বুলেন্স চালক জাহাঙ্গীর বলেন, তিনজন রোগী নিয়ে ইউনাইটেড হাসপাতালে গেছি। পথে একজন মারা গেছে।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে উত্তরা আধুনিক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক এস এম রাকিবুল ইসলাম আকাশ বলেন, দুপুরের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে ১৬০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন। যাদের মধ্যে ৪০-৪৫ জনের অবস্থা গুরুতর ছিল, সবার শরীর ৭০-৮০ শতাংশ পুড়ে গিয়েছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় তাদের জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে পাঠানো হয়েছে। এখন ২৩ জন উত্তরা আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তাদের অবস্থা স্থিতিশীল আছে।