পঞ্চম দফা বন্যায় সিলেট বিভাগে প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখনো বানভাসি। ইউনিসেফের মতে, বানভাসিদের মধ্যে শুধু শিশুই ৮ লাখ। সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর তথ্য অনুযায়ী বিভাগের মধ্যে বানভাসি মানুষের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি সুনামগঞ্জ জেলায়। প্রায় ১৫ লাখ। শুক্রবার থেকে পানি একটু কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ চরমে। ক্ষয়ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আছে ত্রাণের অপ্রতুলতাও।
শুক্রবার সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক এমপি। তিনি বলেন, সুরমা ও কুশিয়ারাসহ সুনামগঞ্জের ২০টি নদী খনন জরুরি।
সুনামগঞ্জ জেলায় প্রায় ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলা প্রশাসন জানায়, জেলার চারটি পৌরসভা এলাকাসহ ৭৮টি ইউনিয়নের ১০১৮ গ্রামের ৬ লাখ ৬০ হাজার ৩৪৭ জন মানুষ বন্যা কবলিত। এর মধ্যে ১৮ হাজার ৪২৯ জন বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন ৫৩১টি আশ্রয়কেন্দ্রে।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী জানান, ইতোমধ্যে যারা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের মধ্যে ১০ টন চাল এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দসহ বণ্টন করা হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবে ত্রাণ মজুত পর্যাপ্ত দেখানো হলেও বাস্তবে তা চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল বলে দাবি করছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সচেতন মহল। সুনামগঞ্জ হাওড় বেষ্টিত অঞ্চল বিধায় প্রত্যন্ত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছানোও অনেকটা দুরূহ।
সিলেট জেলা প্রশাসন শুক্রবার রাতে জানায়, সিলেট মহানগরীর ২৯টি ওয়ার্ডসহ জেলার ১৪৮টি ইউনিয়ন ও ৫টি পৌরসভার ১ হাজার ৫৫২টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত। বানভাসি মানুষের আশ্রয়ের জন্য জেলা ও মহানগর মিলিয়ে ৭১৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ১১ লাখ মানুষের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন মাত্র ২ লাখ ৮৯ হাজার বানভাসি মানুষ। সিলেট নগরীতে এবারের বন্যায় টানা ১৫ দিন ধরে ডুবে আছে নগরীর সি ব্লকের বেশ কয়েকটি বাসাবাড়ি।
মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী জেলায় বানভাসি মানুষের সংখ্যা ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪০২ জন। তাদের মধ্যে ৪২২ টন জিআর চাল, ২ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ নগদ টাকা, ৪৬৫ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং ১২শ রান্না করা খাবার প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন চাহিদার তুলনায় বরাদ্দ অপ্রতুল। হাওড়াঞ্চলের বন্যার্তরা ত্রাণবঞ্চিত।
হবিগঞ্জের ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা সুমী রানী বল জানান, জেলায় বানভাসি মানুষের সংখ্যা ২ হাজার ৭৫০ জন। বন্যাকবলিত ১৩টি ইউনিয়ন। ইতোমধ্যে ৫১০ টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বিতরণ করা হয়েছে ১৬ টন। তিনি দাবি করেন, চাল, নগদ টাকা, গোখাদ্য ও ঢেউটিন পর্যাপ্ত পরিমাণ মজুত আছে। মজুত আছে ২৮১ টন চাল।
এবারের পঞ্চম দফার বন্যায় আগের তুলনায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সিলেট মহানগরী। ৪২ ওয়ার্ডের মধ্যে ২৯টি বন্যা কবলিত। সিলেট নগরে বন্যা আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৫৫ হাজার। এদের মধ্যে ২০টি আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন প্রায় তিন হাজার মানুষ।
শুক্রবার সিলেটের বন্যা পরিস্থিতি পরিদর্শন করে সুরমার কীনব্রিজ তীরে দাঁড়িয়ে পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেন, সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করতে সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আগামীতে সিলেট-সুনামগঞ্জের বন্যাকবলিত এলাকা কিভাবে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে পারি সে লক্ষ্যে আমরা আলোচনা করেছি। তিনি বলেন সুরমা-কুশিয়ারাসহ ২০টি নদী আমরা খনন করব। খনন কাজ করলে নদীতে উজান থেকে নেমে আসা পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এ লক্ষ্যে আমি স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে নির্দেশনা দিয়েছি। উজান থেকে যে পরিমাণ পানি আসে তা ধারণ করার ক্ষমতা তৈরি করার জন্য যেসব নদী ও খাল খনন করার দরকার সিলেটের প্রধান প্রকৌশলীকে নির্দেশনা দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের বন্যার খোঁজখবর রাখছেন, মনিটরিং করছেন। তিনি আমাকে সব সময় সজাগ থেকে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমার আসার আগে এই সিলেটের ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রীকেও তিনি পাঠিয়েছেন। সার্বক্ষণিক তিনি সিলেটের খবর রাখছেন এবং সিলেটবাসীকে বন্যার কবল থেকে রক্ষা করার যা যা করণীয় তা করার নির্দেশনা প্রদান করেছেন।
এ সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ছিলেন সিলেট-৩ আসনের সংসদ-সদস্য হাবিবুর রহমান হাবিব, সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী, জেলা প্রশাসক শেখ রাসেল হাসান, সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী, প্রধান প্রকৌশলী নূর আজিজুর রহমান, কাউন্সিলররা, পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস, সিলেট সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা সাজু লস্কর প্রমুখ।
অপরদিকে বন্যার পানি ঠেকাতে সুরমা নদীর চারপাশে শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবি সিলেট সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর। তিনি বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড এত বছরেও কেন শহর রক্ষা বাঁধ করেনি? এই প্রশ্ন কেউই করে না। তার মতে, সিলেটে ১৫ বছরেও ইফেকটিভ কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি।
এদিকে দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে ইউনিসেফ। বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউনিসেফের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট জানান, বন্যায় ইতোমধ্যে ২০ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে সাত লাখ ৭২ হাজারেরও বেশি শিশু রয়েছে। তাদের জন্য জরুরি সহায়তার প্রয়োজন।
তিনি বলেন, আমাদের অগ্রাধিকার হলো শিশু। ইউনিসেফ বন্যা কবলিত প্রায় এক লাখ মানুষের মধ্যে নিরাপদ পানি বিতরণ করেছে। তিনি আরও জানান, সিলেট বিভাগে ৮১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। ৫০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার হচ্ছে। প্রায় ১৪০টি কমিউনিটি ক্লিনিক বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এদিকে বন্যায় সিলেটের ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টর জমির ফসল প্লাবিত হয়েছে। সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক মোহাম্মদ আনিছুজ্জামান বলেন, পানি না নামলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব নয়। জেলার মাঠে এখনো ফসল আছে ২০ হাজার ৩৮৪ হেক্টর জমিতে। এরমধ্যে ১১ হাজার ৭০৭ হেক্টরের ফসল প্লাবিত।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানায়, সিলেট জেলার বিশ্বনাথে ৮৬১ হেক্টর, গোলাপগঞ্জে ৭৫০, ফেঞ্চুগঞ্জে ৫৬০, গোয়াইনঘাটে ৪১৫, জকিগঞ্জে ৩৫০, ওসমানীনগরে ৩১০, বিয়ানীবাজারে ৯০, কানাইঘাটে ৭৫, দক্ষিণ সুরমায় ৫০, কোম্পানীগঞ্জে ৪০ ও বালাগঞ্জে ৫ হেক্টর আউশ ধান প্লাবিত হয়েছে। আউশ বীজতলা প্লাবিত হয়েছে গোলাপগঞ্জে ১৬০ হেক্টর, বিশ্বনাথে ১৫৪, সিলেট সদরে ১০০, জৈন্তাপুরে ৯৫, দক্ষিণ সুরমায় ৮০, বিয়ানীবাজারে ৫৫, ফেঞ্চুগঞ্জে ৪৮, কানাইঘাটে ৪২, বালাগঞ্জে ৩৫, ওসমানীনগরে ২৯, কোম্পানীগঞ্জে ২৭, জকিগঞ্জে ২৩ ও গোয়াইনঘাটে ৮ হেক্টর রয়েছে।
জেলায় মোট ৬ হাজার ৬১৩ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন সবজি আছে। এর মধ্যে বিশ্বনাথ উপজেলার ১ হাজার ১২০ হেক্টর, সিলেট সদরে ৭২০, বিয়ানীবাজারে ৫৩০, জকিগঞ্জে ৪৬৫, গোলাপগঞ্জে ৪৫০, ফেঞ্চুগঞ্জে ৪৪৮, দক্ষিণ সুরমায় ৪৩৫, বালাগঞ্জে ১৭৫, গোয়াইনঘাটে ১০৫, ওসমানীনগরে ১০০, জৈন্তাপুরে ৮০, কোম্পানীগঞ্জে ৫২ ও কানাইঘাটে ২৮ হেক্টর গ্রীষ্মকালীন সবজি প্লাবিত হয়েছে।
এছাড়াও সিলেটের বোনা আমনের মধ্যে গোয়াইনঘাটে ৮২ হেক্টর, কানাইঘাটে ৩৬, জকিগঞ্জে ১৮, দক্ষিণ সুরমায় ১১, জৈন্তাপুরে ১০ ও বালাগঞ্জে ৪ হেক্টর রয়েছে।
অপরদিকে বন্যায় ২৪ হাজারের বেশি গ্রাহক বিদ্যুবিহীন। বিদ্যুৎ বিভাগের ক্ষতি ১ কোটি ৬৭ লাখ ৫৩ হাজার টাকা। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিউবো) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) সিলেট জোনের বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র, লাইন, ট্রান্সফরমার ও বৈদ্যুতিক পোলের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ দুঃখ প্রকাশ করেছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়, বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেটের অধীনে ৩৩/১১ কেভির মোট ২১টি উপকেন্দ্রের মধ্যে সব উপকেন্দ্রই বর্তমানে চালু রয়েছে, যার মাধ্যমে বিদুৎ সরবরাহ সচল রয়েছে। বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেট বিভিন্ন শ্রেণির মোট গ্রাহক সংখ্যা ৫ লাখ ৬১ হাজার ৬৯ জন। সর্বোচ্চ বিদ্যুতের চাহিদা ২২৫ মেগাওয়াট। বিতরণ অঞ্চল, বিউবো, সিলেট এলাকায় ৯টি ১৩২/৩৩ কেডি গ্রিড উপকেন্দ্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ সরবরাহ দেওয়া হয়।
সিলেট বিভাগে চলমান বৃষ্টিপাত ও উজান হতে বয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যার প্রভাবে ৩৩/১১ কেভি ২১টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ৭টি উপকেন্দ্রের অভ্যন্তর ইয়ার্ডে পানি প্রবেশ করলেও নিরাপদ দূরত্বে থাকায় উপকেন্দ্রগুলো চালু রয়েছে।
সিলেট জোনে বন্যায় বিদ্যুৎ বিভাগের প্রাথমিকভাবে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৪ লাখ ৪০ হাজার টাকা। বিতরণ জোনের আওতাধীন সব এলাকাই কমবেশি বন্যা কবলিত হওয়ায় বন্যার পানি কমার পর প্রকৃত ক্ষয়ক্ষতির সঠিক তথ্য নিরূপণ করা সম্ভব হবে।
এদিকে দফায় দফায় বন্যা হওয়ায় ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত খতিয়ান এখনো পুরোপুরি উঠে আসেনি। তবে বিভিন্ন দপ্তরের খসড়া হিসাব অনুযায়ী চতুর্থ দফার বন্যাতেই ক্ষয়ক্ষতি প্রায় ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। খসড়া হিসাব অনুযায়ী শুধু সিলেট সিটির সড়কে ১০০ কোটি, এলজিইডির সড়কে ১১৮ কোটি, সওজের আওতাধীন সড়কে ৮৪ কোটি, পানি উন্নয়ন বোর্ডের ২০ কোটি, কৃষি বিভাগের ১৪২ কোটি ও মৎস্য খাতে ২০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই হিসাব চতুর্থ দফা বন্যার। পঞ্চম দফা বন্যার পানি নামলে ক্ষয়ক্ষতির পুরো খতিয়ান উঠে আসবে। মোট ক্ষয়ক্ষতি হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।
-তথ্য সূত্র : যুগান্তর