Beanibazar View24
Beanibazar View24 is an Online News Portal. It brings you the latest news around the world 24 hours a day and It focuses most Beanibazar.

ইতালিতে মাফিয়া ডন বনাম ১১ বাংলাদেশি অগ্নিপুরুষ







সিসিলির পালার্মো শহরে এক গাম্বিয়ান অভিবাসীকে গুলি করল এক মাফিয়া, আর রুখে দাঁড়াল ১০ বাংলাদেশি দোকানি। তাদের পাশে দাঁড়াল পালার্মোর জনপ্রতিনিধি ডালিয়া। তারা মুখোমুখি হলো ২৫ বছর পর পুনরুত্থিত ভয়ংকর মাফিয়া সিন্ডিকেট ‘ক্যুপোলা’ গ্রুপের। তারা বলল, ‘আর না’। পরের ঘটনা হলো আন্তর্জাতিক শিরোনাম।

‘মাসুদ রানা’ সিরিজের ‘অগ্নিপুরুষ’ পড়েছেন না? কাজী আনোয়ার হোসেনের সেরা কাজ ‘মাসুদ রানা’, আর ‘মাসুদ রানা’র সেরা তিনের মধ্যে আসবে ‘অগ্নিপুরুষ’-এর নাম। একই কাহিনির ছায়া অবলম্বনে হুমায়ূন আহমেদও ‘অমানুষ’ নামে একটি উন্যাস লিখেছিলেন। দুটি উপন্যাসই ইংরেজ লেখক এ জি কুইনেলের ‘ম্যান অন ফায়ার’ উপন্যাসের ছায়ায় লেখা। ‘অগ্নিপুরুষ’-এর বাঙালি নায়ক মাসুদ রানা দেহরক্ষী হন এক কিশোরীর।



সেই কিশোরীকে মাফিয়ারা টাকার জন্য অপহরণ করে এবং পরে ধর্ষণ করে মেরে ফেলে। পিতৃস্নেহে কাতর এবং প্রতিশোধে অন্ধ দেহরক্ষীরূপী রানা তারপর ধ্বংস করে দেয় ওই মাফিয়া চক্রকে। থ্রিলারের শেষ লড়াইটা হয় সিসিলিতে, নিহত হয় মাফিয়াদের শীর্ষ ‘বস’। বাঙালিদের মধ্যে অগ্নিপুরুষ ঘরের নারী আর বাইরের দুর্বলের সম্মুখে যতটা দেখা যায়, মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ততটা আজকাল দেখা যায় না। নারায়ণগঞ্জের নিহত কিশোর ত্বকীর বাবা রাফিউর রাব্বি অগ্নিপুরুষ হয়ে উঠেছিলেন এক প্রবল যমরাজের বিরুদ্ধে। এখন পর্যন্ত যমরাজ আর তিনি উভয়ের কেউই জয়ীও হননি, পরাজিতও হননি। দুজনই দুজনের জায়গায় দাঁড়িয়ে। যা হোক, তাঁর মতো মানুষেরা ব্যতিক্রম। কিন্তু সুদূর ইতালিতে খুনি মাফিয়া অমানুষ আর বাঙালি অগ্নিকন্যা ও অগ্নিপুরুষেরা সত্যিই মুখোমুখি হয়েছিল অসম লড়াইয়ে। ঠিক যেন ‘অগ্নিপুরুষ’-এরই অহিংস সংস্করণ—বন্দুকের বদলে তারা ব্যবহার করেছিল সাহস।



ঘটনার শুরু অনেক আগে। ৮৩১ থেকে ১০৭২ সাল পর্যন্ত ভূমধ্যসাগরীয় বড় দ্বীপ সিসিলি আরব শাসনে ছিল। তখন থেকেই এটা ছিল বণিকদের ঘাঁটি। এই সিসিলির রাজধানী হলো পালার্মো। অন্য শহরের কেন্দ্রস্থল জমজমাট হলেও পালার্মোর কেন্দ্রস্থল ছিল প্রায় পরিত্যক্ত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের বোমার আঘাত সারাতে অনেক দেরি হয়েছিল। ইতালির অন্য শহরগুলো বিশ্বযুদ্ধের পর নতুন করে বানানো হলেও পালার্মোর বোমাবিধ্বস্ত কেন্দ্রস্থলটা ভাঙাচোরা কপাল নিয়ে চলে গিয়েছিল মাফিয়াদের দখলে। তাদের অত্যাচারে এবং আয়রোজগারের অভাবে শহরটা ছেড়ে চলে যায় প্রায় ২৯ হাজার সিসিলীয়। প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়ে এলাকাটা। তাদের জায়গায় আসে প্রায় ৩০ হাজার অভিবাসী। তাদের বড় অংশই বাংলাদেশি।



বাংলাদেশি অভিবাসীদের এই গল্পের শুরু আশির দশকে। তাদের দেখাদেখি আসতে থাকে আরব, আফ্রিকান ও অন্য এশীয়রা। শহরটার প্রাণকেন্দ্রে বড় বাজার বালারো। বালারোর দোকানগুলো চালায় বাংলাদেশি, নাইজেরীয়, ঘানাদেশীয় অভিবাসীরা। ক্রেতারাও বেশির ভাগ এসব দেশ থেকে অভিবাসী হওয়া কম রোজগারের মানুষ। দোকানের বাইরে বিক্রি হয় চোরাই মাল, মাদক। দোকানের ভেতরে চাঁদাবাজ মাফিয়া-মাস্তানদের ভয়ে থাকতে হয়। যখন-তখন তারা আসে, টাকা নিয়ে যায়, ভয় দেখায়। এভাবেই চলে আসছিল, কেউ তাদের থামানোর সাহস করে না।

২০১৬ সালের কথা। এক বিকেলে স্থানীয় মাফিয়া রুবিনো গুলি করে বসে এক গাম্বিয়ান অভিবাসী ইউসুফা সুসোর মাথায়। ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় অভিবাসীদের।



ভয়ের মন বদলে যায় প্রতিরোধের স্পর্ধায়। সবার সামনে দেখা যায় একদল বাংলাদেশি দোকানদারকে। মাফিয়াদের বিরুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ায় তিউনিসিয়া, গাম্বিয়া, নাইজেরীয় ও বাংলাদেশি অভিবাসীরা। তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় সিসিলীয় অ্যাকটিভিস্টরা। বন্দুকবাজ রুবিনো আটক হয়।

তারা স্থানীয় আদালতে মামলা করে। শুধু রুবিনোকেই নয়, আসামি করা হয় তার গডফাদারদেরও। সেই মামলা উঠিয়ে নেওয়ার চাপ ছিল, হত্যার হুমকি ছিল। কিন্তু সব অস্বীকার করে তারা লেগে থাকে। দুই বছর পর গত নভেম্বর মাসে পালার্মোর আদালত রুবিনোকে দোষী সাব্যস্ত করে। এই আন্দোলনের একজন তোফাজ্জল তপু। তিনি বাংলাদেশ তরুণ প্রজন্ম, ইতালির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। ‘আমি এখানে ২০ বছর ধরে আছি,’ তপু বলেন সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক সাংবাদিককে। তখনো তিনি নিরাপদ নন। বলছিলেন, ‘একদিন একজন আমার দোকানে এল। আমি তাদের বললাম, আর যদি আমার এখানে দেখি, তাহলে যা করার করব।’। তারা পাল্টা হুমকি দিলেও সাহস হারান না তপু।



‘এখানে থাকতে হলে মাফিয়া বসদের খুশি রাখতে হয়। না হলে তারা দোকান লুট করবে। তালা মারবে দোকানে। লোকজন ভয় পেয়ে চুপ থাকে।’ তপু বলতে থাকেন। শহরটার ৫০ লাখ মানুষের মধ্যে পৌনে দুই লাখই অভিবাসী। এদের মধ্যে আছে বাংলাদেশি, আফ্রিকান, শ্রীলঙ্কান, ভারতীয় ও চীনারা। অনেক বাংলাদেশি এখানে সস্তা পণ্য ফেরি করেন রাস্তার মোড়ে মোড়ে। অদ্ভুত ঘটনা হলো এই, মাফিয়াদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধটা স্থানীয়দের দিক থেকে আসেনি, এসেছিল বাংলাদেশিদের তরফে।



এর জন্য তাদের অনেক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। প্রাণনাশের হুমকি, দোকানের তালায় সুপারগ্লু লাগানো। তারপরও যারা কথা শুনত না, তাদের দোকানে হামলা, লুট হতো, মারধর চলত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের একজন হলেন বাংলাদেশি অভিবাসী মোহাম্মদ মিয়া। বহুবার পুলিশকে জানিয়েও প্রতিকার পাননি মোহাম্মদ মিয়া। বাধ্য হয়ে স্বদেশিদের জোট বানিয়ে নিজেদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিজেরাই নিলেন। একজন আক্রান্ত হলেই অন্যরা ছুটে আসতেন। এমনিতেই অল্প আয়ের মানুষ, জীবনধারণের জন্য সংগ্রাম করতে হয়। তার ওপর মাফিয়াদের অত্যাচার ছিল মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। এত অসুবিধা নিয়েও এই বাংলাদেশি বাঙালিরা সিসিলীয় সমাজের মূলধারায় জায়গা করে নিচ্ছিলেন। কেউ কেউ সোনার হরিণসম ইতালীয় নাগরিকত্বও পান, অনেকে পান বৈধ কাগজপত্র।

এঁদেরই একজন ডালিয়া আক্তার সুমি হন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। ‘বালারোতে আমরা ইতিমধ্যে যথেষ্ট সাহস দেখিয়ে মাফিয়াদের রুখে দিয়েছি, বিদেশি হিসেবে এটা করা খুবই কঠিন ছিল।’ তাঁরা যে পালার্মোর সমাজের অংশ—এভাবেই তা প্রমাণিত হয়, বলেন ডালিয়া।



মাফিয়াদের বিরুদ্ধে ওই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন তপুসহ ১১ বাংলাদেশি এবং এক তিউনিসীয়। দুই বছর আগে শুরু হওয়া সেই প্রতিরোধের হাল ছাড়েননি তাঁরা। অবশেষে জয় এল গত ডিসেম্বর। মাসের শুরুতেই গডফাদার সেত্তিমিনো মাইনিওসহ মাফিয়া গ্যাংয়ের ৪৬ জন আটক হয়। এরা মাইনিওর নেতৃত্বে এমন এক সিন্ডিকেট গড়ে তোলে, যারা বৈঠক করে খুন-লুণ্ঠনের সিদ্ধান্ত নিতে পারত। এহেন কুখ্যাত গ্যাং সমূলে আটকের খবর আন্তর্জাতিক শিরোনাম হয়। ২৫ বছর পর আবার তাদের এই উত্থান গুঁড়িয়ে যায় ওই সাহসী ১১ জনের দৃঢ়তায়।



ভয়ংকর ওই গ্যাংয়ের বিচার চলছে, কিন্তু ভয় এখানেই—মাফিয়ারা কখনো পরাজয় মানতে চায় না। মুশকিল হলো তপু, ডালিয়া কিংবা মিয়ার মতো তরুণ বাঙালিরাও জয়ের স্বাদ পেয়ে দারুণ আত্মবিশ্বাসী। দেখা যাক অগ্নিপুরুষ ২.০ পর্বে কী ঘটে।

বিদেশের বাঙালিদের এই সাহস মনে একটা প্রশ্ন জাগায়। ইতালির মতো জায়গায় মাফিয়াদের রাজত্বকে যারা টলিয়ে দেয়, সেই বাংলাদেশিরা নিজ দেশে কেন ভয় পায়? বাঙালি কখন শেরেবাংলা হবে, কখন বিল্লি কা বাংলা হবে, তা কেবল তার গতরের ওপর নির্ভর করে না। ইদানীং বাঙালি বহু ফাঁদে আর বহু লোভে এবং অনেকটা ভয়ে বিল্লি হয়ে আছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকলে এরাই একদিন বাঘ হবে। তবে ফ্যাঁকড়া একখান আছে, বহুদিন হলো আমরা পিঠ ঠেকানোর মতো কোনো দেয়াল খুঁজে পাচ্ছি না। ফলে, পিছু হটারও আর শেষ হচ্ছে না।
সূত্র: দ্য সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, দ্য গার্ডিয়ান ও টাইম ম্যাগাজিন।





You might also like

Comments are closed, but trackbacks and pingbacks are open.